এতদূর থেকেও তারা জব্বার মিয়ার মুখে ভয়ঙ্কর আতঙ্কের চিহ্ন দেখতে পেল, সে নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না। কয়েক মুহূর্ত সে ছুটে আসা বেজিগুলোর দিকে তাকিয়ে রইল, তারপর মাজেদ খানের বাসার দিকে ছুটতে শুরু করল। জয়ন্ত, শ্রাবণী এবং নিয়াজ একটি ভয়ের ছবির দৃশ্যের মতো দেখতে পেল একজন মানুষ তার প্রাণ নিয়ে ছুটছে এবং তার পেছন থেকে সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো ধূসর মৃত্যু এগিয়ে আসছে। জব্বার মিয়া ছুটছে এবং তার মাঝে কয়েকটা বেজি লাফিয়ে তার শরীরের নানা জায়গায় কামড় দিয়ে ঝুলে পড়ল। জব্বার মিয়া হাত দিয়ে সেগুলো ঝেড়ে ফেলার চেষ্টা করে কিন্তু কোনো লাভ হয় না। শেষ পর্যন্ত হাতের পাইপগানটা লাঠির মতো ব্যবহার করে প্রচণ্ড আঘাতে সে কিছু বেজিকে ছিটকে ফেলে দিল। ছুটতে ছুটতে সে একটা গুলি করে বেশকিছু বেজিকে রক্তাক্ত করে দিল কিন্তু তবু বেজিগুলো থামল না। মাজেদ খানের বাসার বারান্দায় দাঁড়িয়ে জয়ন্ত নিয়াজ আর শ্রাবণী দেখতে পেল ছুটতে ছুটতে জব্বার মিয়া বাসার খুব কাছে চলে এসেছে কিন্তু তবু শেষ রক্ষা করতে পারবে বলে মনে হয় না। সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো অসংখ্য বেজি পেছন থেকে একসাথে জব্বার মিয়ার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল এবং টাল সামলাতে না পেরে সে হুমড়ি খেয়ে পড়ে যায়। পরমুহূর্তে দেখা গেল জব্বার মিয়া একটা ধূসর আবরণে ঢেকে গেছে, তার ওপর অসংখ্য বেজি কিলবিল করছে, চোখের পলকে নিশ্চয়ই তাকে ছিন্নভিন্ন করে ফেলবে।
শ্রাবণী চিৎকার করে নিজের মুখ ঢেকে ফেলল। এই ভয়ঙ্কর দৃশ্যটি দেখার মতো সাহস তার নেই।
জয়ন্ত কয়েক মুহূর্ত নিশ্বাস বন্ধ করে দাঁড়িয়ে থাকে, তারপর হঠাৎ যেন সংবিৎ ফিরে পায়। সে চিৎকার করে বলল, জব্বার মিয়াকে বাঁচাতে হবে!
নিয়াজ জিজ্ঞেস করল, কীভাবে?
জানি না। জয়ন্ত বন্দুকে গুলি ভরে নিচে ছুটতে ছুটতে বলল, তোরা মশালে আগুন জ্বালিয়ে আন, তাড়াতাড়ি।
জয়ন্ত চিৎকার করতে করতে ছুটে গেল। জব্বার মিয়া ছটফট করছে, তার ওপরে ঢেউয়ের মতো বেজিগুলো দৌড়াদৌড়ি করছে–তাদের হিংস্র আস্ফালনের মাঝেও জয়ন্ত জব্বার মিয়ার আর্তচিৎকার শুনতে পেল। জয়ন্ত জব্বার মিয়াকে বাঁচিয়ে তার কাছাকাছি বেজিগুলোকে লক্ষ করে গুলি করল। গুলির আঘাতে অসংখ্য বেজি ছিটকে পড়ে যায়– মুহূর্তের জন্যে সেগুলো থমকে দাঁড়ায়, বেশকিছু ছুটে পালিয়ে যেতে চেষ্টা করে। জয়ন্ত সেই অবস্থায় চিৎকার করে জব্বার মিয়ার কাছাকাছি ছুটে যেতে যেতে দ্বিতীয়বার গুলি করল। বেজিগুলো এবারে লাফিয়ে খানিকটা দূরে সরে গেল, কিন্তু একেবারে চলে গেল না। তারা কুতকুতে হিংস্র চোখে জব্বার মিয়া এবং জয়ন্তের দিকে তাকিয়ে রইল।
ততক্ষণে শ্রাবণী এবং নিয়াজও ছুটে আসছে। তাদের দুই হাতে চারটি জ্বলন্ত মশাল। সেখানে দাউদাউ করে আগুন জ্বলছে। আগুন দেখে বেজিগুলো আরো কয়েক পা পিছিয়ে যায়। জয়ন্ত ছুটে গিয়ে এবার জব্বার মিয়াকে টেনে তোলার চেষ্টা করল। সারা শরীর রক্তাক্ত। মনে হয় বেজিগুলো খুবলে তার শরীর থেকে মাংস তুলে নিয়েছে। জব্বার মিয়া চোখ খুলে তাকাল। তার চোখে আতঙ্ক এবং অবিশ্বাস।
নিয়াজ এবং শ্রাবণী মশালগুলো নাড়তে নাড়তে আগুনের শিখা দিয়ে বেজিগুলোকে ভয় দেখাতে দেখাতে এগিয়ে আসতে থাকে। বেজিগুলো নিরাপদ দূরত্বে থেকে একধরনের চাপা গর্জন করতে থাকে। শ্রাবণী এবং জয়ন্ত মিলে জব্বার মিয়াকে টেনে সোজা করে দাঁড় করাল। নিয়াজ মাটি থেকে তার পাইপগানটা তুলে নেয়। এটা দিয়ে কীভাবে গুলি করতে হয় সেটা সম্পর্কে তার কোনো ধারণা নেই, তবু সেটি বেজিদের দিকে তাক করে রাখল।
শ্রাবণী চোখের কোনা দিয়ে বেজিগুলোকে লক্ষ করে, সেগুলো আক্রমণের ভঙ্গিতে তাদের লেজ নাড়ছে। যে–কোনো মুহূর্তে আবার তাদের আক্রমণ করে বসতে পারে। জব্বার মিয়াকে দুই পাশ থেকে ধরে জয়ন্ত আর শ্রাবণী মাজেদ খানের বাসার দিকে নিতে থাকে, তাদের ঠিক পেছনে পেছনে নিয়াজ মশালটি নাড়তে নাড়তে এগিয়ে আসে।
বাসার সিঁড়ির কাছাকাছি পৌঁছে যাবার পর হঠাৎ করে বেজিগুলো আক্রমণ করল। তাদের নিজস্ব কোনো সংকেত আছে–সেটি পাওয়ামাত্রই চলন্ত ট্রেনের মতো ছুটে এসে কয়েক শ বেজি তাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে, তার প্রচণ্ড ধাক্কায় তারা সিঁড়ির ওপরে আছড়ে পড়ল। হাত থেকে মশাল ছিটকে পড়ে এবং হঠাৎ করে শ্রাবণী বুঝতে পারল তাদেরকে বেজিগুলো এখন শেষ করে ফেলবে। ঘাড়ের কাছে কোথায় জানি কয়েকটা বেজি কামড়ে ধরেছে। সেগুলো ছোটানোর জন্যে সে প্রাণপণে চেষ্টা করতে থাকে–কিন্তু একটাকে সরানোর আগেই আরো দশটি এসে জাপটে ধরছে। আগুনের মশালের ওপরে কেউ গড়াগড়ি খাচ্ছে, মাংস এবং লোম পোড়ার একটা উৎকট গন্ধ নাকে এসে লাগে। যন্ত্রণায় কেউ একজন চিৎকার করছে–গলার স্বরটি কার শ্রাবণী বুঝতে পারল না। মৃত্যু তাহলে এরকম–এই ধরনের একটা কথা মনে হল তার, ব্যাপারটি ভয়ঙ্কর, ব্যাপারটি বীভৎস। তার মাথায় একটা বেজি কামড়ে ধরে শক্ত চোয়ালের আঘাতে ছিঁড়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে। পায়ে কয়েকটা কামড়ে ধরে মাংস ছিঁড়ে নিতে চাইছে। ভয়ঙ্কর যন্ত্রণায় শ্রাবণী আর্তনাদ করে উঠল। মৃত্যু যদি আসবেই সেটি তাহলে আরো তাড়াতাড়ি কেন আসছে না?