শ্রাবণী আর নিয়াজ জয়ন্তের কাছে গিয়ে তাকে পরীক্ষা করে। শরীরের নানা জায়গা কেটে গেছে। আগুনের হলকায় বুক পেট হাতের কনুই ঝলসে গেছে। সারা শরীরে কালিঝুলি মেখে তাকে কিম্ভুতকিমাকার দেখাচ্ছে। জয়ন্ত নিয়াজ আর শ্রাবণীর দিকে তাকিয়ে বলল, বেজিগুলো এবার শুধু আমাকে আক্রমণ করল কেন? আমি কী করেছি?
শ্রাবণী চিন্তিতভাবে বলল, হ্যাঁ। আমিও বুঝতে পারছি না। মনে হল একেবারে চিন্তা ভাবনা পরিকল্পনা করে তোকে ধরেছে।
জয়ন্ত কাঁপা গলায় বলল, একসাথে এতগুলো আমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল যে ইচ্ছে করলে আমাকে টুকরো টুকরো করে ফেলতে পারত। কিন্তু মনে হল ওদের অন্য একটা উদ্দেশ্য ছিল
কী উদ্দেশ্য?
কিছু বুঝতে পারছি না। মনে হয়েছে সারা শরীর তন্নতন্ন করে খুঁজেছে কিছু–একটার জন্য
নিয়াজ হঠাৎ চিৎকার করে বলল, এই দ্যাখ।
শ্রাবণী ছুটে গেল, জয়ন্ত পিছু পিছু খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে এগিয়ে গেল। টেবিলের নিচে একটা বেজি মরে পড়ে আছে। সম্ভবত লাঠির আঘাতে মাথাটা পুরোপুরি থেঁতলে গেছে। তবে বেজিটা এখনো শক্ত করে একটা ম্যাচের বাক্স ধরে রেখেছে। নিয়াজ অবাক হয়ে বলল, এটা ম্যাচটা কোথায় পেয়েছে?
জয়ন্ত নিজের পকেটে হাত দিয়ে বলল, আমার ম্যাচ। আমার পকেট থেকে নিয়েছে।
তিনজনই একজন আরেকজনের দিকে অবাক হয়ে তাকাল। জয়ন্ত ফিসফিস করে বলল, বুঝতে পেরেছিস আমাকে কেন ধরেছে?
হ্যাঁ।
আমাকে নিশ্চয়ই ম্যাচ দিয়ে সিগারেট ধরাতে দেখেছে–তাই এখন ম্যাচটা চায়। আগুন ধরানো শিখতে চায়।
নিয়াজ নিচু হয়ে মৃত বেজিটার সামনের দুই পা দিয়ে শক্ত করে ধরে রাখা ম্যাচটি হাতে নিয়ে বলল, তাহলে কি আমরা বেজিদের সাথে একটা সন্ধি করতে পারি? আমরা ওদেরকে এই ম্যাচটা দেব–তারা আমাদের চলে যেতে দেবে!
শ্রাবণী কিছু–একটা বলতে যাচ্ছিল কিন্তু ঠিক তখন মনে হল খুব কাছে থেকে ট্রলারের শব্দটা শোনা যাচ্ছে। তারা প্রায় ছুটে বের হয়ে এসে বারান্দায় দাঁড়াল–সেখান থেকে সমুদ্রের খানিকটা দেখা যাচ্ছে। জব্বার মিয়া তার ট্রলারটা নিয়ে আসছে। শ্রাবণী অবাক হয়ে বলল, কী আশ্চর্য! জব্বার মিয়া এখানে চলে এল কেমন করে? সে কেমন করে জানে আমরা। এখানে?
নিশ্চয়ই নিশ্চয়ই– নিয়াজ ব্যাখ্যা খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা করে সুবিধে করতে পারল না।
নিশ্চয়ই কী?
জয়ন্ত বলল, গুলির শব্দ শুনে অনুমান করেছে আমরা নিশ্চয়ই মাজেদ খানের বাসায় আছি?
হ্যাঁ। তাই হবে!
তিন জন বারান্দায় দাঁড়িয়ে জব্বার মিয়ার দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করতে থাকে। কিন্তু কয়েকটা গাছের আড়ালে থাকার কারণে তারা মোটামুটি বেশ স্পষ্ট জব্বার মিয়াকে দেখতে পেলেও জব্বার মিয়া তাদের দেখতে পাচ্ছে না। নিয়াজ বলল, এই সুযোগ। আমাদের এখন অল্প কিছুদূর যেতে হবে! মাত্র এইটুকু।
কিন্তু মাত্র এইটুকু যেতে কতগুলো বেজি পার হয়ে যেতে হবে দেখেছিস?
হ্যাঁ। শ্রাবণী মাথা নাড়ল, ঠিকই বলেছিস।
কিন্তু কিছু তো করার নেই। আয় মশালে আগুন জ্বালিয়ে বের হয়ে যাই। নিয়াজের কথা শুনে সবাই বাইরে তাকাল। কয়েক হাজার বেজি নিচুপ হয়ে বসে আছে দেখে আবার তারা সাহস হারিয়ে ফেলল। এই দুঃস্বপ্নের জগৎ থেকে পালিয়ে যাবার সুযোগ এত কাছে চলে এসেছে তবুও যেতে পারছে না বলে তারা একধরনের হতাশায় ছটফট করতে থাকে।
তারা দেখতে পেল, জব্বার মিয়া ট্রলারটাকে খানিকটা টেনে তীরে তুলল যেন সমুদ্রের ঢেউয়ে ঢেউয়ে ভেসে না যায়। তারপর রোদ থেকে চোখ আড়াল করে এদিক–সেদিক তাকাল। কিছু দেখতে না–পেয়ে চিন্তিতমুখে নৌকার পাটাতন তুলে তার হাতে বানানো পাইপগানটা তুলে নিয়ে হেঁটে আসতে শুরু করল। হাঁটার ভঙ্গি দেখে বোঝা গেল জব্বার মিয়া এই জায়গাটা মোটামুটি চেনে। সে এখন মাজেদ ধানের বাসার দিকেই আসছে।
জয়ন্ত অন্য দুজনের দিকে তাকিয়ে বলল, সর্বনাশ, এখন দেখি জব্বার মিয়া এদিকে আসছে। একেবারে সোজাসুজি বেজিদের মুখে পড়বে।
হ্যাঁ। ওকে আসতে নিষেধ কর। শ্রাবণী ভয়–পাওয়া গলায় বলল, চিৎকার করে নিষেধ করে দে।
নিয়াজ চিৎকার করে জব্বার মিয়ার দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করল। সেই চিৎকার শুনে বেজিগুলো সচকিত হয়ে পেছনের পায়ে ভর দিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়াল কিন্তু জব্বার মিয়া কিছু শুনতে পেল না। দ্বীপটার ঠিক এই জায়গা দিয়ে সমুদ্রের হাওয়া শনশন করে বইছে। গাছের পাতার শব্দ, সমুদ্রের গর্জন সব মিলিয়ে কিছু শোনার কথা নয়। তিন জন একধরনের আতঙ্ক নিয়ে তাকিয়ে রইল এবং দেখতে পেল জব্বার মিয়া আলগোছে তার পাইপগানটা ধরে ধীরে ধীরে একটা ভয়ঙ্কর বিপদের মুখে পা দিতে আসছে।
শ্রাবণী ফ্যাকাসে মুখে বলল, সর্বনাশ! কী হবে এখন! জব্বার মিয়া যে কিছুই শুনতে পাচ্ছে না—
তিন জনে মিলে আবার চিৎকার করল। মনে হল জব্বার মিয়া কিছু–একটা শুনতে পেল। কিন্তু সেটা শুনে সে থেমে না গিয়ে আরো বেশি উৎসাহ নিয়ে ওপরে ছুটে আসতে শুরু করল।
জয়ন্ত বলল, জব্বার মিয়াকে থামাতে হবে এক্ষুনি থামাতে হবে।
কীভাবে থামাবি?
বন্দুকটা দে একটা গুলি করি। গুলির শব্দ শুনলে থেমে যাবে।
ব্যাপারটা পুরোপুরি চিন্তা না করেই জয়ন্ত বন্দুকটা হাতে নিয়ে একটা ফাঁকা আওয়াজ করল এবং সাথে সাথে জব্বার মিয়া চমকে উঠে একটা গাছের আড়ালে লুকিয়ে গেল। গুলির প্রচণ্ড শব্দে বেজিগুলো এক মুহূর্তের জন্যে নিচু হয়ে যায় এবং পরমুহূর্তে মাথা তুলে তাকিয়ে জব্বার মিয়াকে দেখতে পেয়ে তাকে আক্রমণ করার জন্যে ছুটে যেতে থাকে।