কেন?
তুমি সাংবাদিক, এটা তোমার জানার কথা।
রাহান কোনো কথা বলল না, সে আসলেই জানে। ছোটখাটো সম্পদ মানুষের জীবনে সুখ আনতে পারে, ভয়ংকর ঐশ্বর্যের বেলায় সেটি সত্যি নয়, পারিবারিক জীবনটিকে সেটি একটা কুৎসিত ষড়যন্ত্রে পাল্টে দেয়।
হাজীব বলল, আমি আমার স্ত্রী এবং ছেলেমেয়েকে নিয়ে তোমার সাথে কথা বলতে চাই না।
তাহলে কী নিয়ে কথা বলতে চাও?
তোমাকে নিয়ে।
রাহান অবাক হয়ে বলল, আমাকে নিয়ে?
হ্যাঁ।
আমাকে নিয়ে তুমি কী কথা বলতে চাও?
হাজীব তার ডেস্ক থেকে একটা খবরের কাগজ বের করে টেবিলে রেখে বলল, এখানে তুমি আমার সম্পর্কে একটা বিশাল আলোচনা ফেঁদেছ।
তাকিয়েও রাহান বুঝতে পারে হাজীব কোন লেখাটার কথা বলছে, একটি অত্যন্ত সম্ৰান্ত দৈনিক পত্রিকায় তার এই নিবন্ধটি ছাপা হয়েছিল। হাজীবের টাকার উত্স, তার নানা ধরনের অপরাধ, তার অমানবিক নৃশংসতা কিছুই সে বাদ দেয় নি। হাজীব চেষ্টা করে মুখে একটু হাসি ফুটিয়ে বলল, তুমি এখানে আমার চরিত্রটি বিশ্লেষণ করার চেষ্টা। করেছ।
রাহান মাথা নাড়ল। হাজীব বলল, তুমি আমার সম্পর্কে কতটুকু জান?
পৃথিবীতে তোমার সম্পর্কে যত তথ্য আছে আমি তার সব যোগাড় করে বিশ্লেষণ করেছি।
আমি মানুষটা কেমন বলে তোমার ধারণা?
রাহান একটু ইতস্তত করে বলল, খারাপ।
কত খারাপ?
বেশ খারাপ।
সেটা কতটুকু সে সম্পর্কে তোমার ধারণা আছে?
রাহান কোনো কথা না বলে হাজীবের দিকে তাকিয়ে রইল। হাজীব একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, আমার ধারণা সে সম্পর্কে তোমার কোনো ধারণা নেই।
হাজীব ঠিক কী বলতে চাইছে রাহান সেটা অনুমান করার চেষ্টা করল কিন্তু খুব একটা লাভ হল না। সে কিছু–একটা বলতে যাচ্ছিল কিন্তু তার আগেই হাজীব উঠে দাঁড়াল, বলল, চল।
কোথায়।
এখানে আমার একটা চিড়িয়াখানা আছে, তোমাকে সেটা দেখাব।
চিড়িয়াখানা! রাহান অবাক হয়ে জিজ্ঞেল করল, তোমার নিজস্ব চিড়িয়াখানা আছে?
হ্যাঁ। বড়লোকদের অনেক রকম খেয়াল থাকে। কেউ মূল্যবান রত্ন সগ্রহ করে, কেউ দুষ্প্রাপ্য ছবি সগ্রহ করে–আমি সেরকম দুষ্প্রাপ্য প্রাণী সগ্রহ করি।
দুষ্পপ্য প্রাণী?
হ্যাঁ।
কীরকম দুষ্প্রাপ্য?
আমার কাছে যেগুলো আছে, মনে কর সেগুলো পৃথিবীর কারো কাছে নেই!
সেটি কীভাবে সম্ভব রাহান বুঝতে পারল না। তাহলে কি সে জিনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং ব্যবহার করে নতুন ধরনের প্রাণী তৈরি করেছে? প্রশ্নটি জিজ্ঞেস করতে গিয়ে সে থেমে গেল–এক্ষুনি হয়তো ব্যাপারটি সে নিজের চোখেই দেখতে পাবে।
হাজীবের পিছনে পিছনে রাহান বের হয়ে এল, পিছনে পিছনে কয়েকজন দেহরক্ষী বের হয়ে আসবে বলে রাহান অনুমান করেছিল কিন্তু সেরকম কিছু হল না। মানুষটি নিরাপত্তা নিয়ে খুব বেশি মাথা ঘামায় না, সম্ভবত নানা ধরনের গোপন ক্যামেরা দিয়ে তাদেরকে চোখে চোখে রাখা হয়েছে।
প্রাসাদের মতো দালানটির মারবেল-সিঁড়ি দিয়ে তারা নেমে এল। সিঁড়ির সামনে ছোট একটি গাড়ি রাখা আছে, পাশাপাশি দুজন বসতে পারে। হাজীব রাহানকে ইঙ্গিত করে নিজে অন্যপাশে বসে একটা সুইচ স্পর্শ করতেই গাড়িটি একেবারে নিঃশব্দে চলতে শুরু করল, রাহান কান পেতে অনেক চেষ্টা করেও গাড়ির ইঞ্জিন বা মোটরের শব্দ শুনতে পেল না। গাড়িটি খুব ধীরে ধীরে চলছে, কোন দিক দিয়ে যেতে হবে নিশ্চয়ই প্রোগ্রাম করে রাখা
আছে। গাড়িটির ছাদ নেই বলে খুব খোলামেলা, চারদিকে দেখা যায়। হাজীব সিটে হেলান দিয়ে বলল, সারা পৃথিবীতে আমার একচল্লিশটা দ্বীপ আছে, তবে এটা আমার সবচেয়ে প্রিয়।
এটা কত বড়?
খুব বেশি বড় নয়। এক শ বর্গ কিলোমিটার থেকে একটু ছোট।
এখানে তোমার নিজস্ব এয়ার স্ট্রিপ আছে?
হাজীব হাত নেড়ে বলল, সেজন্য এটি আমার প্রিয় নয়। আমার প্রিয় কারণ এই পুরো দ্বীপটি আসলে একটা সুপ্ত আগ্নেয়গিরি। হাজীব হাত দিয়ে দূরে দেখিয়ে বলল, ওপাশে গ্রানাইটের পাহাড়, ভারি চমৎকার।
বৃক্ষহীন গ্রানাইটের পাহাড় কেমন করে ভারি চমৎকার হতে পারে রাহান বুঝতে পারল, কিন্তু সে কোনো প্রশ্নও করল না। তবে জায়গাটি আশ্চর্য রকম নির্জন, কোথাও কোনো মানুষজন নেই। চিড়িয়াখানাটি কোথায় কে জানে! রাহান বিচিত্র এক ধরনের কৌতূহল নিয়ে ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করে থাকে।
গ্রানাইটের পাহাড়ের খুব কাছাকাছি এলে হঠাৎ একটি সুড়ঙ্গ দেখতে পেল, ঘোট গাড়িটি সেই সুড়ঙ্গ দিয়ে ভিতরে একটা খোলা জায়গায় এসে হাজির হয়। হাজীব তখন সুইচ টিপে গাড়িটি থামিয়ে দিয়ে বলল, এটা আমার চিড়িয়াখানা।
রাহান চারদিকে তাকিয়ে চিড়িয়াখানার কোনো চিহ্ন দেখতে পেল না। সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে হাজীবের দিকে তাকাতেই হাজীব বলল, এদিকে এস।
রাহান হাজীবের পিছু পিছু একদিকে এগিয়ে যায়, উঁচু পাহাড়ের খাড়া দেয়াল উঠে গেছে, সেখানে হাত দিয়ে একটা পাথর সরাতেই উঁকি দেওয়ার মতো একটা জায়গা বের হয়ে গেল। হাজীব সেখানে উঁকি দিয়ে কিছু–একটা দেখে সরে গিয়ে বলল, দেখ। .
রাহান কৌতূহলী হয়ে তাকিয়ে চমকে ওঠে। বেশ খানিকটা দূরে নিচে খানিকটা সমতল জায়গায় বিচিত্র কয়েকটা প্রাণী একটি মৃত ছাগলের দেহ টানাটানি করে খাচ্ছে। কামড়াকামড়ি করে খেতে–খেতে হঠাৎ একটা অন্যটার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল এবং তুলনামূলকভাবে দুর্বল প্রাণীটি চারপায়ে ছুটে দূরে চলে গিয়ে অক্ষম আক্রোশে গর্জন করতে লাগল। প্রাণীটির সিংহের মতো লম্বা কেশর এবং পিছনের দুই পা তুলনামূলকভাবে লম্বা। দেখে মনে হয় কোনো এক ধরনের অপুষ্টির কারণে দেহের লোম ঝরে গেছে। মুখমণ্ডল গোলাকার এবং বানর বা মানুষের সাথে মুখমণ্ডলের মিল রয়েছে। রাহান একটু অবাক হয়ে হাজীবের দিকে তাকাল, জিজ্ঞেস করল, এটি কোন প্রাণী?