কী ডেঞ্জার?
যদি আমাদের আক্রমণ করে বসে আমাদের কিছু করার নেই।
বন্দুকটা আছে।
হ্যাঁ, বন্দুকটা দিয়ে কিছু গুলি করতে পারি–কয়েকটা মারতে পারি কিন্তু তাতে লাভ কী?
শ্রাবণী অস্থির হয়ে বলল, কিন্তু কিছু–একটা তো করতে হবে–আমরা তো এভাবে বসে থাকতে পারব না?
জয়ন্ত একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, বেঁচে থাকার জন্যে দরকার হলে এভাবে বসেই থাকতে হবে। এখনো জব্বার মিয়া আছে–জব্বার মিয়া হচ্ছে আমাদের বাইরের পৃথিবীর সাথে কানেকশন। সে যখন এসে দেখবে আমরা বিচে নাই–তখন নিশ্চয়ই কিছু–একটা করবে। দরকার হলে আমাদের এখানে সাপের সাথে বেজির সাথে বসে থাকতে হবে।
.
বেজিদের দ্বিতীয় আক্রমণটা হল আরো পরিকল্পিতভাবে। বাসার ছাদে ধুপধাপ শব্দ শুনে তারা বারান্দায় এসে দেখে, পাশের একটা বড় কড়ই গাছের ওপরে বেজিগুলো একটা গাছের লতা বেঁধেছে। সেই লতাটি ধরে ঝুল খেয়ে ছাদের ওপর বেজিগুলো লাফিয়ে এসে নামছে। দৃশ্যটি নিজের চোখে না দেখলে তারা বিশ্বাস করত না। বেজির মতো একটা প্রাণী যে গাছের ডালে একটা লতা বাঁধতে পারে সেটাই বিশ্বাস হতে চায় না। দড়ির মতো চমৎকার এরকম একটা লতা কোথায় পেয়েছে সেটাও একটা রহস্য। নিয়াজ বাইনোকুলার দিয়ে দেখে বলল, লতাটি বেণির মতো বুনে নেওয়া হয়েছে।
তিনজন খানিকক্ষণ বেজিদের এই অবিশ্বাস্য কার্যক্রম দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখল। শেষ পর্যন্ত জয়ন্ত বলল, এগুলোকে থামাতে হবে।
নিয়াজ জিজ্ঞেস করল, কীভাবে থামাব?
গুলি করে।
বন্দুকে গুলি ভরতে গিয়ে জয়ন্ত থেমে গিয়ে বন্দুকটা নিয়াজের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, নে এবারে তুই গুলি কর।
আমি আগে কখনো গুলি করি নি।
সেই জন্যেই দিচ্ছি। এইম করে ট্রিগার টেনে ধরবি।
নিশানা যদি না হয়?
না-হওয়ার কী আছে? ছররা গুলি–নিশানার দরকারও নেই।
নিয়াজ গাছের লতা বেঁধে ঝুলে আসা একটা বেজিকে গুলি করতেই বেজিগুলো কর্কশ স্বরে চিৎকার করতে শুরু করল। তারা অবাক হয়ে লক্ষ করল, বেজিগুলো অত্যন্ত সুশৃঙ্খল। চোখের পলকে সেগুলো কোথাও লুকিয়ে গেল। দেখে মনে হল কোথাও কিছু নেই। মিনিট দশেক পর ধীরে ধীরে বেজিগুলো বের হয়ে আসে, তারপর আবার লতাটি টেনে টেনে একটা বেজি গাছের উপর উঠতে থাকে। তাদের ধৈর্যের কোনো অভাব নেই এবং কিছুক্ষণের মাঝে আবার লতায় ঝাল খেয়ে বাসার ছাদে লাফিয়ে পড়তে শুরু করে। দেখে মনে হয় বেজিগুলো। বুঝে গিয়েছে তাদের কাছে গুলি বেশি নেই। এভাবে খুব বেশিবার তাদেরকে উৎপাত করা হবে না।
বাসার ছাদে একটা নির্দিষ্ট সংখ্যা উপস্থিত হওয়ার পর সেগুলো নিশ্চয়ই কার্নিশ বেয়ে ভেতরে ঝাঁপিয়ে পড়বে। একসাথে কতগুলো আসবে এবং কীভাবে আক্রমণ করবে তারা এখনো জানে না। বসে বসে অপেক্ষা করা ছাড়া আর কিছু করার নেই। ছাদে বেজিদের ধুপধাপ শব্দ ছাড়া আর কোথাও কোনো শব্দ নেই। চারপাশে একধরনের ভয়–ধরানো আতঙ্ক। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে এসেছে–কিছুক্ষণ পর অন্ধকার হয়ে আসবে–তখন কী হবে কে জানে!
ঠিক এরকম সময়ে তারা অনেক দূর থেকে একটা ট্রলারের শব্দ শুনতে পেল। শ্রাবণী বলল, জব্বার মিয়া ট্রলার নিয়ে এসেছে।
অন্য দুজন কোনো কথা বলল না। এই ভয়ঙ্কর দুঃস্বপ্নের জগৎ থেকে পালিয়ে যাবার একটা অদম্য ইচ্ছে কাজ করছে কিন্তু কিছু করতে পারছে না। হঠাৎ করে তাদের ভেতরে একধরনের অস্থির হতাশা এসে ভর করে। নিয়াজ প্রায় বেপরোয়া হয়ে বলল, চল মশাল জ্বালিয়ে বের হয়ে যাই।
গত কয়েক ঘণ্টার ঘটনায় তাদের ভেতরে এরকম ভয়ঙ্কর একটা চাপ পড়েছে যে, সেটা সহ্য করা কঠিন হয়ে যাচ্ছিল।
তারা আরেকটু হলে নিয়াজের কথায় হয়তো সত্যি সত্যি বের হয়ে পড়ত। কিন্তু ঠিক তখন হঠাৎ করে ঝুপঝুপ করে চারদিক থেকে বেজিগুলো লাফিয়ে পড়তে শুরু করল। জয়ন্ত চিৎকার করে বলল, ল্যাবরেটরি ঘরে।
কিন্তু জয়ন্তের কথা শেষ হবার আগেই প্রায় বিশ থেকে ত্রিশটি বেজি তার ওপর একসাথে ঝাঁপিয়ে পড়ল। প্রচণ্ড ধাক্কা সহ্য করতে না–পেরে সে হুমড়ি খেয়ে নিচে পড়ে যায়। জয়ন্ত ছটফট করতে থাকে এবং তার সারা শরীরে বেজিগুলো কিলবিল করতে থাকে। নিয়াজ আর শ্রাবণী পাগলের মতো লাঠি দিয়ে মারার চেষ্টা করে কিন্তু সেগুলো ভ্রূক্ষেপ করে না। নিয়াজ এগিয়ে আসা কিছু বেজিকে লক্ষ করে গুলি করে ভয় দেখানোর চেষ্টা করল কিন্তু একই জায়গায় কাছাকাছি জয়ন্ত এবং শ্রাবণী—সে গুলি করতে পারল না। বন্দুকের কুঁদো দিয়ে বেজিগুলোর মাথা আর শরীর থেঁতলে দেওয়ার চেষ্টা করতে লাগল।
শ্রাবণী ছুটে ল্যাবরেটরি-ঘরে গিয়ে দুটো মশাল জ্বালিয়ে নিয়ে বাইরে ছুটে আসে। জয়ন্তকে বাঁচানোর জন্যে মশাল দিয়ে তার শরীরের ওপরেই বেজিগুলোকে এলোপাতাড়ি আঘাত করতে থাকে। এইভাবে তারা কতক্ষণ যুদ্ধ করেছে জানে না কিন্তু শেষ পর্যন্ত বেজিগুলো কর্কশ শব্দ করতে করতে জয়ন্তকে ছেড়ে সরে যায়। জয়ন্ত টলতে টলতে কোনোভাবে উঠে দাঁড়িয়ে প্রচণ্ড আক্রোশে একটা লাঠি তুলে নিয়ে বেজিগুলোর ওপর ঝাঁপিয়ে। পড়ে। লাঠির প্রচণ্ড আঘাতে বেজিগুলোর মাথা ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়, শিরদাঁড়া ভেঙে সেগুলো যন্ত্রণায় ছটফট করতে থাকে। নিয়াজ আর শ্রাবণীর জ্বলন্ত মশালের আগুনের ঝাঁপটায় শেষ পর্যন্ত শেষ বেজিটিও পালিয়ে যাবার পর জয়ন্ত দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে জোরে জোরে নিশ্বাস নিয়ে বলল, মোস্ট পিকুলিয়ার।