জয়ন্তের কথা শুনে এক মুহূর্তের জন্যে হঠাৎ করে দরজায় ধাক্কা থেমে গেল। মনে হল জয়ন্তের কথা বুঝি বুঝতে পেরেছে। কিন্তু পরমুহূর্তে আবার দরজায় ধাক্কাধাক্কি করতে থাকে। কান পেতে ওরা শুনতে পেল, বেজিগুলো মুখ দিয়ে বিচিত্র নানা ধরনের শব্দ করছে।
নিয়াজ আর শ্রাবণী কী করবে বুঝতে পারছে না। যদি কোনোভাবে দরজা ভেঙে বেজিগুলো ঢুকে যেতে পারে তাহলে কী হবে তারা চিন্তাও করতে পারে না। এক মুহূর্তে হয়তো তাদের ছিঁড়েখুঁড়ে ফেলবে।
হঠাৎ ঝনঝন করে কোথায় জানি কাচ ভাঙার শব্দ হল। জয়ন্ত বন্দুক হাতে ল্যাবরেটরির পিছনে ছুটে গিয়ে হতবাক হয়ে যায়। বেজিগুলো আসলেই বুদ্ধিমান সামনে তাদেরকে ব্যস্ত রেখে সেগুলো পিছন দিয়ে ঢুকে পড়ছে। ল্যাবরেটরির পিছনে পর্দার পিছনে কাচের জানালা ভেঙে বেজিগুলো ঢুকতে শুরু করেছে। জয়ন্ত হতবাক হয়ে দেখল, বেজিগুলো মুখে পাথরের টুকরো ধরে সেগুলি দিয়ে কাচের ওপর আঘাত করে কাচ ভেঙে ফেলছে। কাচের ধারালো ভাঙা টুকরোয় বেজিগুলোর পা কেটে যাচ্ছে। কিন্তু সেদিকে ক্ৰক্ষেপ করল না, লাফিয়ে লাফিয়ে ভিতরে ঢুকে গেল। কিছু বোঝার আগেই জয়ন্ত টের পেল গোটাদশেক বেজি তাকে ঘিরে ফেলেছে। জয়ন্ত পিছনে ঘুরে লাথি দিয়ে কয়েকটা বেজিকে দূরে ছুঁড়ে দিয়ে দেয়ালে পিঠ দিয়ে দাঁড়াল, সে পিছন থেকে কোনোটাকে আক্রমণ করতে দিতে চায় না। কিছু বোঝার আগে একটা বেজি লাফিয়ে তার শরীর বেয়ে উপরে উঠে তার চোখে কামড় দেওয়ার চেষ্টা করল–কিন্তু শক্ত পাষ্টিকের গগলস থাকায় সেটা প্লাস্টিকের উপর তার ধারালো দাঁতের চিহ্ন রেখে নিচে গড়িয়ে পড়ল। জয়ন্ত হাত দিয়ে বেজিটাকে সরিয়ে দিয়ে বন্দুক দিয়ে গুলি করার চেষ্টা করে কিন্তু বেজিগুলো ক্রমাগত ছুটছে বলে কিছুতেই নিশানা ঠিক করতে পারে না।
জয়ন্তের চিৎকার শুনে নিয়াজ আর শ্রাবণী লাঠি হাতে ছুটে এসে বেজিগুলোকে আঘাত করার চেষ্টা করে। প্রচণ্ড আঘাতে বেজিগুলো ছিটকে পড়ে বিচিত্র শব্দ করতে শুরু করে। জয়ন্ত ঘরের ভেতরে গুলি করার সাহস পায় না বলে বন্দুকের বাট দিয়ে আঘাত করে কয়েকটার মাথা থেতলে দিল। বেজিগুলো একধরনের জান্তব শব্দ করে তাদের শরীর বেয়ে ওঠার চেষ্টা করে চোখে কামড় দেওয়ার চেষ্টা করতে থাকে। কিন্তু প্লাস্টিকের গগলস থাকায় তারা প্রতিবারই রক্ষা পেয়ে গেল। ঘরের ভেতরে ভয়ঙ্কর একটা নারকীয় পরিবেশের সৃষ্টি হয়ে গেছে। একটার পর একটা বেজি এসে ঢুকছে–কতক্ষণ এদের সাথে টিকে থাকতে পারবে তারা বুঝে উঠতে পারছিল না। অসম্ভব দ্রুত বেজিগুলো কিছু বোঝার আগে তাদের শরীর বেয়ে উপরে উঠে কামড়ে ধরার চেষ্টা করতে থাকে। জয়ন্ত কোনোমতে নিজেকে রক্ষা করার চেষ্টা করে চিৎকার করে বলল, মশালগুলো নিয়ে আয়।
শ্রাবণীর শরীরে কয়েকটা বেজি কামড়ে ধরেছে, তার মাঝে সে কোনোভাবে নিজেকে মুক্ত করার চেষ্টা করে ছুটে গিয়ে মশালটা নিয়ে সলভেন্টের ড্রামে ভিজিয়ে নিয়ে ম্যাচের কাঠি জ্বালিয়ে দিল। সাথে সাথে সেটা দাউদাউ করে জ্বলতে থাকে। দ্বিতীয় মশালটা জ্বালিয়ে সে জয়ন্ত আর নিয়াজের কাছে ছুটে এল। একটা মশাল নিয়াজের হাতে দিয়ে অন্য মশাল নিয়ে এলোপাতাড়ি বেজিগুলোকে মারতে থাকে। সারা ঘরে বেজির লোম পোড়া একটা গন্ধে ভরে যায়। হঠাৎ করে বাইরে থেকে বেজি ঢোকা বন্ধ হয়ে গেল। ভেতরের বেজিগুলোও ঘরের আনাচে–কানাচে লুকিয়ে পড়ে–আগুন জিনিসটাকে মনে হয় সত্যিই ওরা ভয় পায়।
জয়ন্ত হিংস্র গলায় চিৎকার করে বলল, কোথায় পালিয়েছিস বদমাইশ বেজির দল? সবগুলোকে খুন করে ফেলব। জবাই করে ফেলব, পুড়িয়ে কয়লা করে দেব
নিয়াজ আর শ্রাবণীও বেজিগুলোকে খুঁজতে থাকে। কিন্তু বড় ল্যাবরেটরির আনাচে কানাচে কোথায় লুকিয়ে আছে খুঁজে পাওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। এক পলকের জন্যে একটা দেখতে পেলেও সেটা চোখের পলকে অন্য কোথাও সরে যাচ্ছে।
হঠাৎ এক কোনা থেকে একটা বেজি ছুটে বের হয়ে এসে অবিকল মানুষের গলায় বলল, ক্রিঁকি ক্রিঁকি এবং এরকম শব্দ করতে করতে সেটি জানালার ফুটো দিয়ে বের হয়ে গেল। সাথে সাথে ঘরের আনাচে–কানাচে লুকিয়ে থাকা বেজিগুলোও ক্রিঁকি ক্রিঁকি শব্দ করতে করতে ছুটে পালিয়ে যেতে শুরু করে। নিয়াজ, শ্রাবণী আর জয়ন্ত প্রচণ্ড আক্রোশে পালিয়ে যেতে থাকা বেজিগুলোকে লাঠি দিয়ে আঘাত করার চেষ্টা করে কয়েকটার মাথা থেঁতলে দিল।
শেষ বেজিটি পালিয়ে যাবার পর তারা ল্যাবরেটরি–ঘরটির চারদিকে তাকাল। সমস্ত ঘরের লণ্ডভণ্ড অবস্থা। গোটা–ছয়েক বেজি মরে পড়ে আছে। গোটা–দশেক অধমৃত হয়ে এখানে–সেখানে ছটফট করছে। নিজেদের দিকে তাকানো যায় না–চোখগুলো বেঁচে গিয়েছে কিন্তু শরীরের প্রায় পুরোটুকু ক্ষতবিক্ষত। জামাকাপড় ছিঁড়ে গিয়ে রক্তাক্ত হয়ে আছে। শ্রাবণী নিয়াজ এবং জয়ন্তের দিকে তাকিয়ে বলল, আমাকে দেখতে যদি তোদের মতো দেখাচ্ছে তাহলে খবর বেশি ভালো নয়।
জয়ন্ত বন্দুকটা দেয়ালে হেলান দিয়ে রেখে বলল, তোকে আরো বেশি খারাপ দেখাচ্ছে।
কত খারাপ?
ডাইনি বুড়ির মতো।
থ্যাংক ইউ জয়ন্ত। তোর মতো আন্তরিক সমবেদনাসম্পন্ন মানুষ পাওয়া খুব কঠিন।
নিয়াজ নিজের হাতপায়ের দিকে লক্ষ করে বলল, আমার এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না যে এটা ঘটেছে।