জয়ন্ত বাইনোকুলার চোখে লাগিয়ে বারান্দায় গুড়ি মেরে বসে ছিল, পায়ের শব্দ শুনে চোখ তুলে তাকিয়ে নিয়াজ আর শ্রাবণীকে বন্দুক হাতে আসতে দেখে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, বন্দুক! কোথায় পেলি?
সোফার কুশনের নিচে লুকানো ছিল। শ্রাবণী বলল, বন্দুকটা হাতে নেওয়ার পর থেকে নিয়াজ মাস্তান–মাস্তান ব্যবহার করছে!
জয়ন্ত বাইনোকুলারটা শ্রাবণীর কাছে দিয়ে বন্দুকটা হাতে নিয়ে চাপ দিয়ে সেটা খুলে ব্যারেলের ভেতর দিয়ে তাকিয়ে বলল, ময়লা হয়ে আছে পরিষ্কার করতে হবে।
শ্রাবণী অবাক হয়ে বলল, তুই বন্দুক চালাতে পারিস?
আমার এক মামা পাখি শিকার করতেন, তার সাথে মাঝে মাঝে যেতাম।
পাখি শিকার! শ্রাবণী চোখ কপালে তুলে বলল, ইশ! কী নিষ্ঠুর।
তুই কি চিকেন খাস না?
খাই। কেন?
চিকেন একধরনের পাখি। সেটা জ্যান্ত খাওয়া হয় না। মেরে কেটেকুটে খাওয়া হয়– সেটা নিষ্ঠুর না?
নিয়াজ বাইনোকুলারটা নিয়ে বেজিগুলোকে দেখার চেষ্টা করছিল। জয়ন্ত বলল, দেখেছিস? মোষ্ট ফেসিনেটিং।
শ্রাবণী জিজ্ঞেস করল, কী জিনিস মোস্ট ফেসিনেটিং?
এই বেজিগুলো। মনে হচ্ছে এদের মাঝে একটা সমাজব্যবস্থা তৈরি হয়েছে।
এতে অবাক হবার কী আছে? প্রায় জন্তুদেরই তো সমাজব্যবস্থা থাকে। জংলী কুকুর, হায়না, হাতি
না, না, সেরকম না। এখানে মনে হচ্ছে এদের দায়িত্ব ভাগ করা আছে। কেউ কেউ শ্রমিক–কেউ কেউ
আঁতেল?
জয়ন্ত শব্দ করে হেসে বলল, হ্যাঁ অনেকটা সেরকম। ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক আর ডিসকভারি চ্যানেলে সব সময়ে দেখেছি জন্তু–জানোয়ারে সবেচেয়ে যেটা বেশি শক্তিশালী সেটাই হচ্ছে নেতা। কিন্তু এখানে মনে হচ্ছে অন্য ব্যাপার।
কী ব্যাপার?
কড়ই গাছের নিচে শুকনো হাড় জিরজিরে একটা বেজি বসে আছে আর অনেকগুলো ধুমসো মোটা বেজি সেটাকে পাহারা দিচ্ছে। মাঝে মাঝে কোনো বেজি দেখা করতে আসে–সেটাকে এস্কর্ট করে নিয়ে যায়, হাড় জিরজিরে বুড়ো বেজিটার সামনে গিয়ে মাথা নিচু করে থাকে। আর সবচেয়ে পিকুলিয়ার
কী?
মনে হয় এই বেজিগুলোর একটা ভাষা আছে, নিজেদের মাঝে এরা কথা বলে। মনে হয় হাড়–জিরজিরে বুড়ো বেজিটা হাত নাড়িয়ে কথা বলে, কিছু একটা অর্ডার দেয়। সে–ই নেতা।
সত্যি?
হ্যাঁ, দ্যাখ বাইনোকুলারটি দিয়ে।
শ্রাবণী বাইনোকুলারটি চোখে দিয়ে দূরে তাকায়। কড়ই গাছের নিচে গাছের গুঁড়িতে হেলান দিয়ে একটা শুকনো দুর্বল বেজি বসে আছে। গাছটিকে ঘিরে আরো অনেকগুলো বেজি। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলেই বোঝা যায়, এই শুকনো হাড়-জিরজিরে দুর্বল বেজিটি আসলে দুর্বল নয়–অন্য বেজিগুলো ক্রমাগত তার কাছে আসছে এবং যাচ্ছে, আদেশ নিচ্ছে এবং ছুটে চলে যাচ্ছে। যদি ব্যাপারটি এরকম পরিবেশে না হত তাহলে শ্রাবণী নিশ্চিতভাবে এর মাঝে খানিকটা কৌতক খুঁজে পেত কিন্তু এখন সে কোনো কৌতুক খুঁজে পেল না।
.
ঠিক দুপুরবেলা বেজিগুলো প্রথমবার তাদের আক্রমণ করল। নিয়াজ বাইনোকুলার চোখে দিয়ে বসে ছিল। হঠাৎ করে সে চিৎকার করে বলল, বেজিগুলো কিছু একটা করছে।
জয়ন্ত ল্যাবরেটরি–ঘরে কিছু কাঠের টুকরায় কাপড় বেঁধে মশাল তৈরি করছিল। সেগুলো টেবিলে রেখে চিৎকার করে জানতে চাইল, কী করছে?
ছুটোছুটি করছে।
কেন?
বুঝতে পারছি না।
কিন্তু কিছুক্ষণের মাঝেই কারণটা বোঝা গেল। বেজিদের বিশাল বাহিনী থেকে একটা বিরাট অংশ হঠাৎ করে বাসাটির দিকে ছুটে আসতে শুরু করল। এর মাঝে তারা বাসার দরজা জানালা যতটুকু সম্ভব বন্ধ করে দিয়েছিল কিন্তু তবু বেজিগুলোকে নিরুৎসাহিত করা গেল না। পুরোনো বাসার ফাঁকফোকর দিয়ে সেগুলো পিলপিল করে ভেতরে ঢুকতে রু করে। জয়ন্ত হাতে বন্দুক নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। শ্রাবণী আর নিয়াজ বড় বড় লাঠিগুলো নিয়ে অপেক্ষা করে।
এই ঘরের ভেতরে যদি ঢুকে যায় তাহলে গুলি করব। ঠিক আছে?
অন্য দুজন মাথা নাড়ল।
মশালগুলো রেডি আছে। সলভেন্টে চুবিয়ে শুধু আগুন লাগাতে হবে।
ঠিক আছে।
সিরিঞ্জগুলোতে এসিড ভরে রেখেছি–খুব কাছে এলে সেটা পুশ করে দেওয়া যেতে পারে কিন্তু সেটা হচ্ছে একেবারে নিরুপায় হলে। লাস্ট রিসোর্ট।
শ্রাবণী বলল, আমার মনে হয় সবাই চোখে পাষ্টিক গগলসটা পরে নিই।
হ্যাঁ, যদি কোনোভাবে ঘরে ঢুকে যায় তাহলে কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে।
বেজিগুলো বুদ্ধিমান, কাজেই তারা খুব বুদ্ধিমানের মতো কিছু করবে এরকম একটা আশঙ্কা ছিল। কিন্তু দেখা গেল সেরকম বুদ্ধিমানের মতো কিছু করল না। দল বেঁধে বেজিগুলো তাদের কাছাকাছি আসার চেষ্টা করতে লাগল। নিচে দরজা জানালা বন্ধ থাকলেও জানালার ভাঙা কাচ এবং ঘরের ফঁকফোকর দিয়ে সেগুলো ঢুকতে শুরু করল। কিছুক্ষণের মাঝেই সিঁড়িতে ধুপধাপ শব্দ শোনা গেল এবং তারপরই ল্যাবরেটরির দরজায় সেগুলো ধাক্কা দিতে শুরু করল। ল্যাবরেটরির দরজাটা ছিটকিনি দিয়ে বন্ধ করে রাখা আছে। কয়েকটা বেজি সেগুলো ধাক্কা দিয়ে খুলতে পারবে না। তবু তারা তিনজন আতঙ্কে সিঁটিয়ে রইল। শুধু যে দরজা ধাক্কা দিচ্ছে তা নয়, তারা দেখতে পেল দরজার নব ঘুরিয়ে বেজিগুলো দরজা খোলার চেষ্টা করছে। ব্যাপারটি অবিশ্বাস্য যে বেজির মতো একটা প্রাণী জানে দরজা খোলার জন্যে নব ঘোরাতে হয়।
কী করবে বুঝতে না পেরে জয়ন্ত দরজার ভেতর থেকে কয়েকটা লাথি মেরে চিৎকার করে বলল, বদমাইশ বেজির বাচ্চা বেজি। ভাগ এখন থেকে, না হলে খুন করে ফেলব গুলি করে।