নিয়াজ এবং শ্রাবণী নিঃশব্দে জয়ন্তের দিকে তাকিয়ে রইল। জয়ন্ত বলল, আগেই কেন ভয়ে কাবু হয়ে থাকব। ব্যাপারটা দেখা যাক। এই ডায়েরিটা পাঁচ বছর আগে লেখা, পাঁচ বছরে কত কী হতে পারে।
উল্টোটাও হতে পারে। নিয়াজ বলল, পাঁচ বছর আগে এটা যত ভয়ঙ্কর ছিল এখন হয়তো আরো অনেক বেশি ভয়ঙ্কর হয়ে গেছে।
হ্যাঁ। উল্টোটা হতে পারে কিন্তু আগেই সেটা ধরে নেব কেন? এই যে আমরা তিন জন হেঁটে হেঁটে এসেছি, আমাদের কিছু হয়েছে? সত্যিই যদি ভয়ঙ্কর বেজি আক্রমণ করে মানুষকে মেরে ফেলতে পারত–তাহলে আমাদের মারল না কেন?
তা ঠিক। নিয়াজ মাথা নেড়ে বলল, তাহলে তুই কী করতে চাস?
প্রথমে এখান থেকে বের হয়ে বাসাটা দেখি। কী হচ্ছে না হচ্ছে বোঝার চেষ্টা করি। এখন মনে হচ্ছে জব্বার মিয়ার বন্দুকটা নিয়ে এলে খারাপ হত না।
মাজেদ খানের একটা বন্দুক ছিল, সেটা খুঁজে দেখলে হয়।
শ্রাবণী ভুরু কুঁচকে বলল, তুই কখনো বন্দুক দিয়ে গুলি করেছিস?
না। কিন্তু সেটা আর কত কঠিন হবে?
একটা নাকি ধাক্কা লাগে বেকায়দা ধাক্কা লেগে নাকি মানুষ উন্টে পড়ে।
ধুর। বাজে কথা। পুঁচকে পুঁচকে সন্ত্রাসীরা বন্দুক দিয়ে কাটা রাইফেল দিয়ে গুলি করছে না?
তুই তো আর সন্ত্রাসী না। সন্ত্রাসী হলে তো আর চিন্তা ছিল না।
যাই হোক নিয়াজ বলল, এখন আর সেটা নিয়ে চিন্তা করার দরকার নেই। আমাদের কাছে বন্দুক নাই, আছে বাঁশের লাঠি, সেটা হাতে নিয়ে বের হতে হবে।
হ্যাঁ। জয়ন্ত লাঠিটা হাতে নিয়ে দরজার দিকে এগিয়ে গেল।
সাবধানে দরজা খুলে তারা ল্যাবরেটরি–ঘর থেকে বের হয়। একটা ছোট করিডর ধরে হাঁটতে থাকে। পাশাপাশি কয়কটা ঘর, একটা সম্ভবত স্টোর রুম, একটা লাইব্রেরি, আরেকটা ছোট বিশ্রাম করার ঘর। করিডরের একপাশে দরজা, দরজা খুলে সম্ভবত বারান্দায়। যাওয়া যায়। দরজাটার সামনে দাঁড়িয়ে একটু ইতস্তত করে জয়ন্ত দরজা খুলে বের হয়ে এল। ভেতরে অন্ধকার থেকে হঠাৎ করে প্রখর আলোতে এসে তাদের সবার চোখ ধাঁধিয়ে গেল। মোমবাতিগুলো ফুঁ দিয়ে নিভিয়ে তারা বারান্দায় রেলিঙের কাছে এগিয়ে যায় ভালো করে দেখার জন্যে তাদের কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে হল। উজ্জ্বল আলোতে চোখ সয়ে যাবার পর তারা আবিষ্কার করল এই বারান্দাটি থেকে একপাশে সমুদ্রের চমৎকার একটি দৃশ্য দেখা যায়, অন্যপাশে দ্বীপের গাছগাছালি। তাদের মনের ভেতরে বেজি নিয়ে ভয়ঙ্কর দুর্ভাবনাটি না থাকলে নিঃসন্দেহে এখানে দাঁড়িয়ে তারা দৃশ্যটি উপভোগ করত। তারপরও তারা সেখানে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল। শ্রাবণী হেঁটে বারান্দার অন্যপাশে এসে বনের দিকে তাকিয়ে থাকে। বড় বড় গাছ, গাছের নিচে ঝোঁপঝাড়। গাছপালা ঝোপঝাড়ের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে শ্রাবণী একধরনের অস্বস্তি বোধ করে, অস্বস্তিটি ঠিক কেন বোধ করছে সে ধরতে পারে না তার শুধু মনে হয় ওখানে কিছু একটা জিনিস ঠিক নেই। শ্রাবণী রেলিঙে ঝুঁকে পড়ে আরো তীক্ষ্ণচোখে তাকাল, হঠাৎ করে মনে হল গাছের নিচে ঝোঁপের আড়ালে কিছু-একটা যেন নড়ে উঠেছে। শ্রাবণী তীক্ষ্ণচোখে তাকিয়ে হঠাৎ ভয়ানকভাবে চমকে ওঠে। বাসাটি ঘিরে গাছপালাগুলোর নিচে যতদূর চোখ যায় অসংখ্য বেজি নিশ্চল হয়ে বসে আছে। এতদূর থেকে বোঝা যায় না কিন্তু তাদের ছোট ছোট কুতকুতে চোখ তাদের দিকে স্থিরদৃষ্টিতে নিবদ্ধ হয়ে আছে। শ্রাবণী আতঙ্কে একটা আর্ত চিৎকার করে উঠল এবং সেই চিৎকার শুনে নিশ্চল বেজিগুলো একসাথে পেছনের দুই পায়ের ওপর ভর দিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়াল।
জয়ন্ত কাঁপা গলায় বলল, কী হয়েছে?
শ্রাবণী হাত তুলে দেখাল, ঐ দ্যাখ।
জয়ন্ত এবং নিয়াজ তাকিয়ে দেখে বাসাটি ঘিরে কয়েক হাজার বেজি পেছনের পায়ের ওপর ভর দিয়ে নিশ্চল হয়ে দাঁড়িয়ে স্থিরচোখে তাদের তিন জনের দিকে তাকিয়ে আছে।
.
আমরা যখন হেঁটে আসছিলাম–এই কয়েক হাজার বেজি ইচ্ছে করলে আমাদের ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে ফেলতে পারত। শ্রাবণী বলল, কেন করে নি কে জানে।
জয়ন্ত কিংবা নিয়াজ কোনো কথা বলল না।
একটি দুটি খ্যাপা জন্তু-জানোয়ার থেকে রক্ষা পাওয়া যায় কিন্তু এরকম কয়েক হাজার থেকে রক্ষা পাবে কেমন করে?
নিয়াজ একটু নড়েচড়ে বলল, জব্বার মিয়া। আমাদের একমাত্র ভরসা জব্বার মিয়া।
শ্রাবণী বলল, কীভাবে?
জব্বার মিয়া এসে যখন দেখবে আমরা নেই–তখন আমাদের খোঁজ নেওয়ার একটা ব্যবস্থা করবে না?
সেটা কখন করবে? ততক্ষণ আমরা কী করব?
ততক্ষণ যেভাবেই হোক আমাদের বেঁচে থাকতে হবে।
জয়ন্ত এতক্ষণ চুপচাপ ওদের কথা ছিল। এবারে সোজা হয়ে বসে বলল, দ্যাখ– আমরা মনে হয় ব্যাপারটাকে একটু বেশি মেলোড্রামাটিক করে ফেলছি। বাইরে যে–প্রাণীটা দুই পায়ের ওপর ভর করে দাঁড়িয়ে আছে সেই প্রাণীটা কী? প্রাণীটা হচ্ছে বেজি। একটা বেজির ভয়ে আমরা আঁকুপাকু করব সেটা ঠিক হচ্ছে না
শ্রাবণী বাধা দিয়ে বলল, একটা নয়–কয়েক হাজার
জয়ন্ত প্রায় নাটকের ভঙ্গিতে পা দিয়ে শব্দ করে বলল, কয়েক হাজার হোক আর কয়েক লক্ষ হোক তাতে কিছু আসে যায় না। বেজি হচ্ছে বেজি। আমি এই লাঠি দিয়ে পিটিয়ে এদের বারোটা বাজিয়ে দেব।
অনেকক্ষণ পর প্রথমবার শ্রাবণীর মুখে হাসি ফুটে উঠল, বলল, শুনে খুশি হলাম। এই পিটানোর কাজটা কখন শুরু করবি? এখনই বের হবি লাঠি হাতে?