নিয়াজ ডায়েরির পৃষ্ঠা উল্টাতে উল্টাতে হঠাৎ করে থেমে গিয়ে আবার পড়তে শুরু করল, বুদ্ধিহীন প্রাণী চলে সহজাত প্রবৃত্তি দিয়ে কিন্তু বুদ্ধিমান প্রাণী নতুন জিনিস শিখতে পারে। এই বেজিগুলো বুদ্ধিমান। তারা প্রতিদিন নতুন জিনিস শিখছে। আজকে আবিষ্কার করলাম, বেজিগুলো আমার পোষা কুকুরটিকে মেরে ফেলেছে। রাত্রিবেলা কুকুরটার চিৎকার শুনে আমি বন্দুক নিয়ে ছুটে বের হয়ে গেছি। কিন্তু ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে। বেজিগুলো জানে–একটা প্রাণীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ হচ্ছে তার দৃষ্টি। কাজেই সবার আগে সেগুলো কুকুরটার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তার চোখ দুটো খুবলে তুলে নিয়েছে। তার পরের অংশটি সহজ। বেজিগুলো ধারালো দাঁত দিয়ে কুকুরের ঘাড়ের বড় আর্টারিটা ছিন্ন করে দিয়েছে। কী নৃংশস! বেজিগুলো তাদের থেকে অনেক বড় প্রাণীকে হত্যা করতে শিখে গেছে এখন কি আমাদের হত্যা করবে?
আমার ল্যাবরেটরি এসিস্টেন্ট খুব ভয় পেয়েছে। ভয় পাওয়ারই কথা।
নিয়াজ ডায়েরি থেকে মুখ তুলে বলল, মনে আছে জব্বার মিয়া কী বলেছিল?
কী বলেছিল?
চোখ দুটো সাবধান।
হ্যাঁ। মনে আছে—
এখন বুঝেছিস তো কেন?
কেউ কোনো কথা না বলে নিয়াজের দিকে তাকিয়ে রইল। নিয়াজ ডায়েরির পৃষ্ঠা উন্টাতে উল্টাতে হঠাৎ করে থেমে যায়। একটা বড় নিশ্বাস নিয়ে আবার পড়তে শুরু করল, আজকে আমার ল্যাবরেটরি এসিস্টেন্ট খুন হয়ে গেল। মৃতদেহটি বাসার সামনে পড়ে ছিল। চোখ দুটো খুবলে নিয়ে ঘাড়ের বড় আর্টারিগুলো ধারালো দাঁত দিয়ে কেটে নিয়েছে। কাজটি করেছে প্রায় নিঃশব্দে। আমি রাতে কোনো শব্দও শুনতে পারি নি। তাকে আমি ঘর থেকে বের হতে নিষেধ করেছিলাম। কিন্তু সে আমার কথা না–শুনে ঘর থেকে বের হয়েছিল। কেন বের হল? আমার ধারণা বেজিগুলো কোনো একটা বুদ্ধি করে তাকে বের করে নিয়েছে। এখন এই দ্বীপে আমি একা। আমার ধারণা বাইরে থেকে কোনো সাহায্য না পেলে আমার অবস্থাও আমার ল্যাবরেটরি এসিস্টেস্টের মতো হবে।
নিয়াজ আবার মুখ তুলে তাকাল। জয়ন্ত জিজ্ঞেস করল, ডায়েরি কি এখানেই শেষ?
না। আরো কয়েক পৃষ্ঠা আছে।
কী লেখা আছে এখানে?
নিয়াজ পড়তে শুরু করে, বুদ্ধিমান প্রাণীর প্রথম প্রচেষ্টাই হল তার বুদ্ধিমত্তাকে ছড়িয়ে দেওয়া। কাজেই এই বেজিগুলো যে সেরকম চেষ্টা করবে সে–ব্যাপারে আমার কোনো সন্দেহ নেই। এই দ্বীপের যেদিকেই তাকাই সেদিকেই আমি বেজিগুলোকে দেখতে পাই। নিষ্পলক দৃষ্টিতে দূর থেকে আমাকে লক্ষ করে। দৃষ্টিগুলো দেখে আমার বুক কেঁপে ওঠে। আমি আজকাল ঘর থেকে বের হই না। মাথার কাছে লোডেড বন্দুকটা রাখি। কিন্তু কেন। জানি মনে হয়, এই বন্দুক আমাকে রক্ষা করতে পারবে না। আমার মনে হয়, এটি খুব বড় সৌভাগ্য যে বেজিগুলো এই দ্বীপের মাঝে আটকা পড়ে আছে। এখান থেকে অন্য দ্বীপে কিংবা দেশের মূল ভূখণ্ডে যেতে পারছে না। যদি একবার চলে যায় তখন কী হবে! ভেবেই আমার বুক কেঁপে ওঠে।
আমি কদিন থেকেই ভেবে বের করার চেষ্টা করছি একটি প্রাণী যদি হঠাৎ করে বুদ্ধিমান হয়ে ওঠে তার ফল কী হতে পারে। মানুষ ক্রমবিবর্তনে ধীরে ধীরে বুদ্ধিমান হয়ে উঠেছে। কিন্তু এই বেজিগুলোর ব্যাপারটি সম্পূর্ণ ভিন্ন। এরা বিবর্তনে বুদ্ধিমান হয় নি। এরা। বুদ্ধিমান হয়েছে আমার একটা ভুলের জন্যে। আমি অগ্র–পশ্চাৎ বিবেচনা না করে এই এক্সপেরিমেন্টটি করে ফেলেছি এবং বেজিটি আমার হাতছাড়া হয়ে গেছে। পৃথিবীর মানুষ আমাকে যেন ক্ষমা করে।
আমার মনে হয় প্রাণীটা বুদ্ধিমান হবার পর নিশ্চয়ই তারা ভাব বিনিময় করার জন্যে নিজেদের একটা ভাষা আবিষ্কার করেছে। ডেকের ওপর বসে আমি বাইনোকুলার দিয়ে চারপাশের বেজিগুলোকে দেখি। মনে হয় এগুলো এখন নিজেদের মাঝে কথা বলছে। মনে হচ্ছে বেজিগুলোর নিজস্ব কোনো ভাষা আছে। শুধু–যে ভাষা আছে তা নয় মনে হয় সামনের পা দুটোকে হাত হিসেবে ব্যবহার করার চেষ্টা করে। আজকাল আমাকে খুব সাবধান থাকতে হয়–মনে হয় বেজিগুলো ঘরের ছিটকিনি খুলে ভেতরে ঢুকে যেতে পারে।
যে–জিনিসটি এখনো বেজিগুলো শিখে নি সেটা হচ্ছে আগুনের ব্যবহার। তাহলে কি এই আগুন দিয়েই কোনোভাবে এদের ধ্বংস করতে হবে? আমি জানি না।
আমার কী হবে আমি জানি না। আমি যে ভুল করেছি সেজন্যে ঈশ্বর আমাকে ক্ষমা করুন।
নিয়াজ ডায়েরিটা বন্ধ করে ওদের দিকে তাকিয়ে বলল, ডায়েরিটা এখানেই শেষ।
কিছুক্ষণ কেউ কোনো কথা বলল না। মোমবাতির আলোটি স্থির হয়ে ছিল, মাঝে মাঝে কেঁপে উঠছে, দেয়ালে তাদের বড় ছায়া পড়েছে। শ্রাবণী কাঁপা গলায় বলল, এখন কী হবে?
মাজেদ খানের একটা বন্দুক ছিল, সে পুরো ব্যাপারটা জানত তারপরও নিজেকে বাঁচাতে পারে নাই। আমরা কেমন করে বাঁচব? নিয়াজ সবার দিকে তাকিয়ে বলল, আমাদের কোনো আশা নেই।
সব আমার দোষ। জয়ন্ত মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, আমি যদি তোদের জোর করে নিয়ে আসতাম–
ওসব বলে লাভ নেই। আমরা কেউ বাচ্চা শিশু না, কেউ কাউকে জোর করে আনতে পারে না।
তবুও–আমি যদি–
ওসব কথা বলে লাভ নেই। শ্রাবণী মাথা নেড়ে বলল, এখন কী করা যায় সেটা বল।
এমন কি হতে পারে যে আমরা শুধু-শুধু জয় পাচ্ছি?
মানে?
এই যে বুদ্ধিমান বেজির ব্যাপারটা– আসলে এটা খানিকটা বাড়াবাড়ি। আসলে সেরকম কিছু নেই। একটা বেজি আর কত বিপজ্জনক হবে? এইটুকু একটা জন্তু–