নিয়াজ বই এবং কাগজপত্র ঘাটতে ঘাটতে হঠাৎ করে বলল, এই দ্যাখ! কী পেয়েছি।
কী? জয়ন্ত মাইক্রোস্কোপ থেকে চোখ তুলে নিয়াজের দিকে তাকাল।
ডায়েরি।
ডায়েরি? শ্রাবণী নিয়াজের কাছে এগিয়ে এল।
হ্যাঁ। পার্সোনাল ডায়েরি। নিয়াজ পৃষ্ঠাগুলো উল্টাতে থাকে এবং হঠাৎ করে সেখান থেকে ভাজ–করা একটা কাগজ নিচে পড়ল। শ্রাবণী কাগজটা তুলে নিয়ে ভাজ খুলে তাকায়, ভেতরে টানা হাতে কিছু একটা লেখা। শ্রাবণী কৌতূহলী হয়ে মোমবাতির আলোতে পড়ার চেষ্টা করল। মানুষটির হাতের লেখা সুন্দর হলেও পড়তে কষ্ট হয়।
সম্ভবত লিখেছে খুব তাড়াহুড়ো করে। সেজন্যে পড়তে শ্রাবণীর সময় লাগল। পড়ে হঠাৎ করে শ্রাবণীর রু কুঞ্চিত হয়ে ওঠে। সে কাঁপা গলায় বলল, কী লেখা এখানে?
নিয়াজ মুখ তুলে তাকাল, বলল, কী লেখা?
শ্রাবণী ভয়-পাওয়া গলায় বলল, পড়ে দ্যাখ।
নিয়াজ কাগজটি হাতে নিয়ে মোমবাতির আলোতে পড়ার চেষ্টা করে। সেখানে লেখা, এ আমি কী করেছি! একজন একজন করে সবাইকে খুন করেছে এখন কি আমার পালা? কেউ যদি ভুল করে এই দ্বীপে চলে আসে তার কী হবে?
ওরা একজন আরেকজনের দিকে তাকাল। জয়ন্ত ফিসফিস করে বলল, কী লিখেছে এখানে? কে খুন করেছে? কাকে খুন করেছে?
নিয়াজ ডায়েরিটার পৃষ্ঠা উল্টাতে থাকে। পেছন থেকে কয়েক পৃষ্ঠা পড়ে। তারপর কিছু পৃষ্ঠা আগে চলে আসে। হঠাৎ করে সে মুখ তুলে তাকায়। মোমবাতির আলোতে দেখায় তার মুখ ভয়ে রক্তশূন্য হয়ে আছে। শ্রাবণী ভয় পাওয়া গলায় বলল, কী লেখা আছে ডায়েরিতে?
বেজি!
বেজি? কী হয়েছে বেজির?
এই বেজিগুলো সাধারণ বেজি সয়। মাজেদ খান জিনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং করে ওদের মাঝে বুদ্ধিমত্তার একটা জিন্স ঢুকিয়ে দিয়েছে।
কী বলছিস তুই!
হ্যাঁ। এই দ্যাখ। নিয়াজ ডায়েরির পৃষ্ঠা খুলে পড়ে শোনাল, সুইডেনের ক্ৰান্স ল্যাবরেটরিতে প্রফেসর সোয়ন্সন যে এক্সপেরিমেন্টটি করেছেন আমি আজকে সেটি করেছি। বেজির যে ক্লোনটি তৈরি করেছি তার তিন নম্বর ক্রমোজমে বুদ্ধিমত্তার জিন্সটিতে মানুষের বুদ্ধিমত্তার জিন্সটি বসিয়ে দিয়েছি। জানি না এই ভ্রূণটা ঠিকভাবে বড় হবে কি না–যদি বড় হয় তাহলে প্রথম একটা স্তন্যপায়ী প্রাণীর মাঝে মানুষের এরকম একটা জিন্স ঢুকিয়ে দেওয়া হল।
নিয়াজ মুখ তুলে তাকাল। কাঁপা গলায় বলল, তার মানে বুঝতে পারছিস? মাজেদ খান এখানে কিছু বেজি তৈরি করেছে যেগুলোর বুদ্ধিমত্তা মানুষের মতো–
জয়ন্ত মাথা নেড়ে বলল, কী বলছিস পাগলের মতো?
আমি পাগলের মতো বলছি না, এই দ্যাখ মাজেদ খান কী লিখেছে। নিয়াজ ডায়েরির আরো কিছু পৃষ্ঠা উল্টিয়ে পড়তে থাকে। বেজিটির বুদ্ধিমত্তা অন্য বেজি থেকে বেশি কি না সেটা আজকে প্রমাণিত হয়ে গেল। বেজিটি খাঁচা থেকে পালিয়ে গেছে। এই খাঁচা থেকে কোনোভাবে বেজিটির পালিয়ে যাবার কথা নয়। কারণ বুদ্ধিমত্তাহীন কোনো প্রাণী এই খাঁচার ছিটকিনি খুলতে পারবে না। শুধুমাত্র অত্যন্ত উন্নত শ্রেণীর বুদ্ধিমত্তা আছে এরকম একটা প্রাণীই ছিটকিনি খুলে বের হয়ে যেতে পারে। কাজটি খুব ভুল হয়ে গেল। সম্পূর্ণ নতুন একটি প্রাণী ছাড়া পেয়ে গেল। এখন এটি যদি তার বাচ্চাদের মাঝে এই বুদ্ধিমত্তার জিন্স ছড়িয়ে দেয়? তারা যদি নতুন বাচ্চার জন্ম দেয়? এই পুরো দ্বীপটি যদি বুদ্ধিমান বেজি দিয়ে ভরে ওঠে?
শ্রাবণী ভয়-পাওয়া গলায় বলল, তার মানে আমাদের পিছু–পিছু যে বেজিটা আসছিল সেটা মানুষের মতো বুদ্ধিমান?
কেউ শ্রাবণীর কথার উত্তর দিল না। নিয়াজ ডায়েরির পৃষ্ঠা উল্টাতে উল্টাতে হঠাৎ থেমে গিয়ে বলল, এই দ্যাখ কী লেখা–আমি এই দ্বীপের সব বেজিগুলো মারার চেষ্টা করেছি। গুলি করে মারার চেষ্টা করেছি। বিষাক্ত খাবার দিয়ে মারার চেষ্টা করেছি। কিন্তু সেই বুদ্ধিমান বেজিকে মনে হয় মারতে পারি নি। আজকে প্রথম কিছু বেজির বাচ্চাকে পিছনের দুই পায়ে ভর দিয়ে ছুটে যেতে দেখলাম। তাহলে কি বুদ্ধিমান নতুন বেজির বাচ্চার জন্ম হয়েছে? সর্বনাশ। এখন কী হবে? আমি বেজিগুলোকে মারার চেষ্টা করেছি বলে আমাকে শক্ত হিসেবে ধরে নিয়েছে। এই বেজিগুলো কি এখন থেকে আমাকে কিংবা সব মানুষকেই শত্রু হিসেবে বিবেচনা করবে?
মোমবাতির আলোতে সবাই চুপ করে বসে থাকে। কেউ কোনো কথা বলতে পারে না। নিয়াজ ডায়েরির পৃষ্ঠা উল্টাতে উল্টাতে হঠাৎ করে থেমে গিয়ে আবার পড়তে শুরু করল, বেজিদের একটি বুদ্ধিমান প্রজন্মের জন্ম হলে তারা কী করবে? সবার আগে নিজেদের খাবার সগ্রহের ব্যাপারটি নিশ্চিত করবে। আজকে আমি তাই আবিষ্কার করেছি। তারা একটি বড় গর্ত করে সেখানে সাপদের এনে জড়ো করেছে। আমি জানতাম না সাপ তাদের এত প্রিয় খাবার। সাপগুলোকে বাঁচিয়ে রাখার জন্যে ইঁদুর ধরে এনে গর্তের মাঝে ছেড়ে দিচ্ছে। অবিশ্বাস্য ব্যাপার!
নিয়াজ মুখ তুলে তাকিয়ে বলল, এখন বুঝতে পারছিস আমি যেই গর্তটাতে পড়তে যাচ্ছিলাম সেটা কোথা থেকে এসেছে?
হ্যাঁ। বুঝতে পেরেছি।
শ্রাবণী ভয়-পাওয়া গলায় বলল, এখন কী হবে?
জয়ন্ত অনিশ্চিতের মতো মাথা নাড়ল, বলল, আমি জানি না। সে ধীরে ধীরে দরজার কাছে হেঁটে গিয়ে দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে ভেতর থেকে ছিটকিনি আটকে দিল। অন্য দুজন একধরনের আতঙ্ক নিয়ে জয়ন্তের দিকে তাকিয়ে থাকে। হঠাৎ করে ছিটকিনি আটকে দিয়ে তারা প্রথমবার স্বীকার করে নিল এখানে তারা একটা ভয়ঙ্কর বিপদের মুখোমুখি এসে পড়েছে।