তিন জন হেঁটে হেঁটে বাসাটির বারান্দায় এসে দাঁড়ায়। জানালাগুলো খোলা। কাচ ভেঙে গিয়ে কেমন যেন অসহায় মানুষের মতো দাঁড়িয়ে আছে। জয়ন্ত দরজাটি ধাক্কা দিতেই সেটি ক্যাচ ক্যাচ শব্দ করে খুলে গেল। কয়েক সেকেন্ড অপেক্ষা করে জয়ন্ত ধীরে ধীরে ভেতরে ঢোকে। দীর্ঘদিন কেউ না আসায় ঘরের ভেতরে একধরনের ভ্যাপসা গন্ধ। জয়ন্ত সাবধানে চারদিকে তাকিয়ে আরো কয়েক পা ভেতরে ঢুকে হাত দিয়ে অন্য দুজনকে ইঙ্গিত করতেই তারা ভেতরে ঢুকল।
ঘরটি একসময় নিশ্চয়ই সুন্দর করে সাজানো ছিল, এখনো তার কিছু চিহ্ন রয়ে গেছে। তিন জন সাবধানে হেঁটে ঘরটিকে পরীক্ষা করে। একটি শেলফ কাত হয়ে পড়ে আছে। একটা টেবিল–ল্যাম্প একপাশে ভাঙা। একটা সুদৃশ্য চেয়ার। ঘরের দেয়ালে ধূলি–ধূসরিত একটা অয়েল পেইন্টিং–শ্রাবণী কাছে গিয়ে ফুঁ দিতেই খানিকটা জায়গা পরিষ্কার হয়ে উজ্জ্বল রঙ বের হয়ে এল। শ্রাবণী দেয়ালে টাঙানো অন্য ছবিগুলো পরীক্ষা করে দেখল, এলোমেলো। চুলের হাসিখুশি একজন মানুষ একটি বিদেশী মেয়ের পাশে দাঁড়িয়ে আছে। শ্রাবণী বলল, এটা নিশ্চয়ই পাগলা ডাক্তার।
জয়ন্ত এগিয়ে এসে বলল, তুই কেমন করে বুঝতে পারলি?
দেখছিস না পাশে ফরেনার মেয়ে?
পাশে ফরেনার মেয়ের সাথে পাগলা ডাক্তারের কী সম্পর্ক?
আমাদের দেশের যত সাকসেসফুল মানুষ তাদের সবার বিদেশী বউ।
তোকে বলেছে!
বিশ্বেস কলি না?
আর এই পাগলা ডাক্তার সাকসেসফুল কে বলেছে? সাকসেসফুল মানুষ এরকম জঙ্গলে থাকে? থেকে খুন হয়ে যায়?
শ্রাবণী দার্শনিকের মতো মুখভঙ্গি করে বলল, বেঁচে থাকাটাই যদি জীবনের অর্থ হয়ে থাকে তাহলে কচ্ছপ হচ্ছে সবচেয়ে সাকসেসফুল। কয়েক শ বছর বেঁচে থাকে।
নিয়াজ একটু অধৈর্য হয়ে বলল, অনেক ফিলসফি হয়েছে। এখন চল যাই।
জয়ন্ত বলল, একটু অন্য ঘরগুলো দেয়ে যাই।
কথা ছিল ঢুকব এবং বের হব।
এই তো ঢুকেছি। এখন অন্য ঘরগুলোতে ঢুকে বের হয়ে যাব।
নিয়াজ হতাশ হওয়ার ভঙ্গিতে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল।
নিচের সবগুলো ঘরই ধুলায় ধূসর। মাকড়সার জাল এবং পোকামাকড়ে ঢেকে আছে। কিছু ব্যবহারী জিনিস, দেয়ালে আরো কিছু ছবি, কয়েকটা আসবাবপত্র পাওয়া গেল। দোতলায় ওঠার সিঁড়িটা একটু নড়বড়ে মনে হল। জায়গাটা দিনের বেলাতেই অন্ধকার, তাই মোমবাতি দুটো জ্বালিয়ে নেওয়া হল। তিন জন সাবধানে সিঁড়ি দিয়ে উঠতে থাকে। জয়ন্ত কয়েক পা উঠে বলল, সিঁড়ি মনে হয় ঘূণ ধরে ক্ষয়ে গেছে। সাবধান।
শ্রাবণী জিজ্ঞেস করল, সাবধানটা কীভাবে হব? ওজন কম করে দেব?
তা বলছি না। নিচে দেখে পা ফেলিস। রেলিংটা শক্ত করে ধরে রাখিস। হঠাৎ করে ভেঙে গেলে যেন আছাড় খেয়ে পড়ে না যাস।
নিয়াজের মতো!
হ্যাঁ, নিয়াজের মতো।
নিয়াজ বিরক্ত হয়ে বলল, ব্যাপারটা ফানি ছিল না। যদি পড়ে যেতাম তাহলে মরে যেতাম।
শ্রাবণী বলল, এবং হকুনদিয়ার নামটি সার্থক হত।
উপরে উঠে একটা দরজা পাওয়া গেল। দরজাটি বন্ধ। জয়ন্ত কয়েকবার ধাক্কা দিয়ে। বলল, তালা মারা রয়েছে।
আমাদের কাছে চাবি নাই–কাজেই এখন এটি মিশন ইমপসিবল।
জোরে একটা লাথি দিয়ে দেখি, তালা ভাঙতে পারি কি না।
একজনের বাসায় তালা ভেঙে ঢোকা আইনত দণ্ডনীয়।
জয়ন্ত দাঁত বের করে হেসে বলল, কিন্তু যদি সেই বাসাটা হয় হকুনদিয়ার পাগলা ডাক্তারের বাসা এবং সেই বাসায় গত পাঁচ বছর কেউ ঢুকে না থাকে তাহলে সেটা আইনত দণ্ডনীয় নয়। সেটা ভদ্রতা–
বলে জয়ন্ত একটু পিছিয়ে এসে প্রচণ্ড জোরে লাথি দিল। দীর্ঘদিনের অব্যবহারে মরচে পড়ে তালা নিশ্চয়ই নড়বড় হয়ে ছিল, জয়ন্তের লাথিতে তালা ভেঙে দরজা শব্দ করে ভেতরের দিকে খুলে যায়। শ্রাবণী চোখ বড় বড় করে বলল, তোর পায়ে জোর তো ভালোই আছে। রাত্রিবেলা মানুষের ঘরের দরজা ভেঙে বেড়াস নাকি?
জয়ন্ত বুকে থাবা দিয়ে বলল, হাফ ব্যাক, নাজিরপুর উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়, ফুটবল টিমের ক্যাপ্টেন।
নিয়াজ জয়ন্তকে পাশ কাটিয়ে ভেতরে ঢুকে একটা বিস্ময়সূচক শব্দ করল, বলল, কী আশ্চর্য!
জয়ন্ত এবং শ্রাবণী ভেতরে ঢুকে নিয়াজের মতোই চমকৃত হয়ে যায়। ভেতরে অত্যন্ত চমৎকার আধুনিক একটি ল্যাবরেটরি। চমৎকার শ্বেতপাথরের টেবিল। দামি মাইক্রোস্কোপ। উপরে তাকে কাচের শেলফ। টেবিলের পাশে ছোট ফ্রিজ, হিটার সেন্ট্রিফিউজ। পাশে শেলফে সারি সারি বই খাতা, নোট বই।
শ্রাবণী অবাক হয়ে বলল, এই ল্যাবরেটরিটা দেখি একেবারে চকচক করছে।
দরজা জানালা সব বন্ধ ছিল বলে নষ্ট হয়নি।
কী সুন্দ ল্যাবরেটরি দেখেছিস? নিয়াজ মুগ্ধ হয়ে চারদিকে তাকিয়ে বলল, এরকম একটা জঙ্গুলে জায়গায় কেউ এরকম ল্যাবরেটরি তৈরি করতে পারে?
নিয়াজ হাতের মোমবাতিটা নিয়ে শেলফের দিকে এগিয়ে গিয়ে একটা বই টেনে নেয়। ধুলা ঝেড়ে বইটা দেখে বলল, জিনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিঙের বই।
তার মানে পাগলা ডাক্তার একজন জিনেটিক ইঞ্জিনিয়ার ছিল?
নিয়াজ বইয়ের প্রথম পৃষ্ঠায় হাতে–লেখা নামটি পড়ে বলল, পাগলা ডাক্তারের ভালো নাম মাজেদ খান। ড. মাজেদ খান।
এরকম সুন্দর একটা নাম থাকার পরও তাকে সবাই পাগলা ডাক্তার ডাকে কেন?
আমাকে জিজ্ঞেস করিস না। আমি এই নাম দিই নি। নিয়াজ শেলফ থেকে আরো কয়েকটা বই নামিয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে। নিয়াজ পড়াশোনা সংক্রান্ত ব্যাপারে খুব উৎসাহী। কোনো বই পেলে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে না–দেখে নামিয়ে রাখে না। যদিও একটু আগে সে চলে যাবার জন্যে অধৈর্য হয়ে উঠেছিল কিন্তু হঠাৎ করে বই এবং কাগজপত্র দেখে সে খুব উৎসাহী হয়ে ওঠে। মোমবাতিটা টেবিলে বসিয়ে সে কাগজপত্র বের করে দেখতে থাকে। জয়ন্ত একটা মাইক্রোস্কোপের ধুলা ঝেড়ে চোখ লাগিয়ে দেখার চেষ্টা করে। শ্রাবণী একধরনের বিস্ময় নিয়ে ঘরের মাঝামাঝি দাঁড়িয়ে থাকে। তার এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না যে এরকম একটি নির্জন দ্বীপে একজন মানুষ এরকম চমৎকার একটি ল্যাবরেটরি দাঁড় করিয়ে ফেলতে পারে।