নিয়াজ মাথা নাড়ল, মনে হয় না। একটু-আধটু ছাল উঠে গেছে।
শ্রাবণী তার ব্যাগ খুলে একটা মলম জাতীয় টিউব বের করে বলল, নে, লাগিয়ে নে। এন্টিসেপটিকের কাজ করবে।
নিয়াজ শুকনো গলায় বলল, পড়ে গেলে কী হত?
কী আর হতদড়ি দিয়ে বেঁধে আমরা টেনে তুলে ফেলতাম।
মনে আছে জব্বার মিয়া বলেছিল গর্তের মাঝে পড়ে গিয়ে মরে গিয়েছিল?
এই গর্তের ভেতর পড়লে কেউ মরে যায় না–বড়জোর হাত–পা ভেঙে যেত। শ্রাবণী আবার গর্তের ভেতরে উঁকি দিয়ে হঠাৎ কী একটা দেখে আতঙ্কে চিৎকার করে পিছনে সরে গেল।
জয়ন্ত ভয় পাওয়া গলায় বলল, কী? কী হয়েছে?
ভেতরে তাকিয়ে দ্যাখ।
জয়ন্ত একটু এগিয়ে গিয়ে ভেতরে তাকাল। ভেতরে অন্ধকার, ভালো দেখা যায় না। সরসর করে এক ধরনের শব্দ হচ্ছে। সে রোদ থেকে চোখ আড়াল করে ভেতরে তাকিয়ে শিউরে উঠল, এক মানুষ সমান একটি গর্তের নিচে কিলবিল করছে সাপ। একটি–দুটি সাপ নয়–অসংখ্য সাপ। জয়ন্ত নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারে না। এক ধরনের আতঙ্ক নিয়ে সে নিশ্বাস বন্ধ করে তাকিয়ে থাকে।
নিয়াজ অবাক হয়ে গুঁড়ি মেরে এগিয়ে এল, বলল, কী?
জয়ন্ত ফিসফিস করে বলল, সাপ।
সাপ?
হ্যাঁ।
কী সাপ?
জানি না তাকিয়ে দ্যাখ।
নিয়াজ রোদ থেকে চোখ আড়াল করে নিচে তাকিয়ে হতচকিত হয়ে গেল। কিছুক্ষণ সে নিশ্বাস নিতে পারে না। তারপর বড় একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, তোরা যদি আমাকে টেনে তুলতে না পারতি কী হত বুঝতে পারছিস?
জয়ন্ত মাথা নাড়ল।
আমি আর এখানে এক সেকেন্ডও থাকছি না। চল যাই।
জয়ন্ত কোনো কথা না বলে মন্ত্রমুগ্ধের মতো গর্তের নিচে তাকিয়ে থাকে। নিয়াজ বলল, কী হল? কথা বলছিস না কেন?
স্নেক–পীট। এটা হচ্ছে সাপের গর্ত–এখানে সাপেরা থাকে।
হ্যাঁ। সাপদের বাসা।
কিন্তু_
কিন্তু কী?
গর্তের দেয়ালটা তাকিয়ে দ্যাখ।
কী দেখব?
দেখেছিস দেয়ালটা কত মসৃণ? তার মানে এখান থেকে কোনো সাপ বের হতে পারে না।
শ্রাবণী কয়েক হাত পিছনে দাঁড়িয়ে থেকে বলল, তুই কী বলতে চাইছিস?
সাপগুলো যদি এখান থেকে বের হতে না পারে তাহলে ওরা খায় কী?
শ্রাবণী চোখ পাকিয়ে বলল, সাপের লাঞ্চ ডিনার নিয়ে তোর এত মাথাব্যথা কেন?
না, জয়ন্ত একটু অধৈর্য হয়ে বলল, বুঝতে পারছিস না–দেখে মনে হচ্ছে এখানে কেউ সাপগুলোকে পুষছে?
একটু আগেই তুই-ই না বললি এখানে কোনো মানুষ নাই?
সেই জন্যেই তো বুঝতে পারছি না।
শ্রাবণী মাথা নেড়ে বলল, সাপদের বের হওয়ার জন্যে লিফট লাগে না। তারা গর্ত দিয়ে বের হতে পারে। নিচে গর্ত আছে। আর না থাকলে তারা গর্ত করে নেবে।
জয়ন্ত মাথা নাড়ল, বলল, তা ঠিক। কিন্তু
কিন্তু কী?
দেখে মনে হয়, কেউ যেন খুব যত্ন করে একটা স্নেক–পীট তৈরি করেছে। দ্যাখ একবার তাকিয়ে দ্যাখ।
শ্রাবণী মুখ শক্ত করে বলল, জয়ন্ত, পৃথিবীতে রাজাকারদের পরে আমি যে-জিনিসটা ঘেন্না করি সেটা হচ্ছে সাপ। কাজেই তুই আমাকে সাপ দেখানোর চেষ্টা করবি না।
জয়ন্ত উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ঠিক আছে, তোকে দেখানোর চেষ্টা করব না। কিন্তু এটা একটা ফ্যাসিনেটিং জায়গা।
নিয়াজ বলল, আমার মতো আছাড় খেয়ে ভেতরে তো পড়িস নি তাই মনে হচ্ছে ফ্যাসিনেটিং জায়গা।
ব্যথা তো পাস নি।
ব্যথা না–পেলে কী হবে? ভয় পেয়েছি। ভয়। বুঝলি?
জয়ন্ত নিয়াজের কাঁধে হাত রেখে বলল, আই অ্যাম সরি নিয়াজ। আমি খুব ইনসেনসেটিভ মানুষের মতো ব্যবহার করছি।
ঠিক আছে। এখন সেনসেটিভ মানুষের মতো ব্যবহার কর। এখান থেকে বের হ।
জয়ন্ত পকেট থেকে সিগারেট বের করে মুখে লাগিয়ে সাবধানে ম্যাচ দিয়ে সিগারেটটা ধরিয়ে একটা লম্বা টান দিয়ে দূরের বাসাটির দিকে তাকিয়ে বলল, বাসাটার এত কাছে এসে না–দেখে চলে যাব?
নিয়াজ ক্রুদ্ধ হয়ে বলল, তোর এখনো শখ আছে?
না মানে, এখন তো ব্যাপারটা পরিষ্কার হয়ে গেল। এরকম একটা গর্তে পড়ে গিয়ে মানুষ সাপের কামড় খেয়ে মারা যায়। এর মাঝে কোনো রহস্য নেই–কোনো ভৌতিক ব্যাপার নেই।
তুই কী বলতে চাইছিস?
আমি বলছিলাম কি–এখন যেহেতু কারণটা জেনে গিয়েছি আমাদের তো ভয় পাওয়ার কিছু নেই। ঐ বাসাটায় গিয়ে একটু ঘুরে দেখে আসি।
নিয়াজ শ্রাবণীর দিকে তাকাল। শ্রাবণী বলল, জয়ন্তের কথায় একটা যুক্তি অবিশ্যি আছে। এতদূর যখন এসেছি বাসাটা দেখে যাই। দেখি পাগলা ডাক্তারের কোনো রহস্যভেদ করতে পারি কি না।
জয়ন্ত বলল, তুই নিশ্চিত থাক–এবার আখি সামনে সামনে যাব। লাঠি দিয়ে ঠুকে ঠুকে দেখব কোনো গর্ত আছে কি না।
নিয়াজ একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, চল। কিন্তু তোদের বলে রাখছি, বাসাটায় যাব, ঢুকব আর বের হব।
ঠিক আছে।
ওয়ার্ড অব অনার?
জয়ন্ত নাক মুখ দিয়ে ধোঁয়া ছেড়ে বলল, ওয়ার্ড অব অনার।
.
তিন জনের ছোট দলটা বাসার সামনে এসে একধরনের মুগ্ধ বিস্ময় নিয়ে তার দিকে তাকিয়ে রইল। জংলী গাছপালায় পুরোটা ঢেকে গিয়েছে কিন্তু তবু বোঝা যায় একসময় এটি নিশ্চয়ই ছবির মতো একটা সুন্দর বাসা ছিল। দোতলা কাঠের বাসা। ওপরে একটি চমৎকার ডেক। এখানে বসে নিশ্চয়ই সমুদ্রের একটা চমৎকার দৃশ্য দেখতে পাওয়া যায়। বাসাটি ঘিরে যত্ন করে গাছ লাগানো হয়েছিল। সেগুলো পুরো এলাকাটিকে ছায়া দিয়ে ঢেকে রেখেছে। একসময়ে একটা গেট ছিল। এখন সেখানে কিছু নেই। সুড়কি বিছানো ছোট একটা পথ।