রগারিজ ক্রুচিনকে আবার এক মুহূর্তের জন্যে একটু অসহায় দেখায়। তার নিচের ঠোঁট আবার একটু নড়ে ওঠে, মনে হয় সে আবার কিছু একটা বলার চেষ্টা করছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সে কিছু বলল না।
ঠিক সেই মুহূর্তে প্রতিরক্ষাবাহিনীর দশজন সদস্যের হাতের স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রগুলো ভয়ংকর শব্দ করে গর্জে উঠল। রগারিজ ক্রুচিনের দেহটি বুলেটের আঘাতে কয়েকবার কেঁপে উঠে হাঁটু ভেঙে পড়ে গেল। কয়েকবার কেঁপে উঠে দেহটি স্থির হয়ে যায়, তার ঢিলেঢালা সাদা শার্টটি রক্তে ভিজে উঠতে শুরু করে।
***
প্রবীণ সাংবাদিকের সাহায্যকারী কমবয়সী মেয়েটি ক্যামেরার বিভিন্ন অংশ স্টেনলেসের বাক্সে সাজিয়ে রাখতে রাখতে বলল, তুমি কি একটা জিনিস লক্ষ করেছিলে?
কী জিনিস?
রগারিজ ক্রুচিনের নিচের ঠোঁটটি কয়েকবার নড়ে উঠেছিল। মনে হয়েছিল সে যেন কিছু–একটা বলতে চায়।
হ্যাঁ। প্রবীণ সাংবাদিক মাথা নাড়ল, আমি লক্ষ করেছিলাম।
সে কী বলতে চেয়েছিল বলে মনে হয়?
তার বলার কিছু নেই। প্রবীণ সাংবাদিক হাত নেড়ে পুরো ব্যাপারটিকে উড়িয়ে দেবার ভঙ্গি করে বলল, বিচার অত্যন্ত নিরপেক্ষ হয়েছে। তার বিরুদ্ধে সবগুলো অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে।
তা ঠিক।
প্রবীণ সাংবাদিক একটি বড় নিশ্বাস ফেলে বলল, রগারিজ ক্রুচিনের বিচার করে তাকে মৃত্যুদণ্ড দিয়ে আসলেই আমরা একটা অনেক বড় আত্মগ্লানি থেকে মুক্তি পেলাম।
তা ঠিক। মেয়েটি স্টেনলেস স্টিলের বাক্সটি বন্ধ করতে করতে বলল, এমন কি হতে পারে সে বলতে চেয়েছিল যেহেতু প্রকৃত বগারিজ ক্রুচিন আজ থেকে তিরিশ বছর আগে হৃদরোগে মারা গেছে সেহেতু এখন তার জন্যে আর কাউকে শাস্তি দেওয়া যায় না?
প্রবীণ সাংবাদিক অবাক হয়ে বলল, কেন সে এরকম একটা কথা বলতে চাইবে? সে তো অন্য কেউ নয়, সে রগারিজ ক্রুচিনের ক্লোন, সে এক শ ভাগ রগারিজ ক্রুচিন, তাকে শাস্তি দেওয়ার জন্যেই আলাদা করে ল্যাবরেটরিতে তৈরি করা হয়েছে।
কমবয়সী মেয়েটি কিছু–একটা বলতে চাইছিল কিন্তু প্রবীণ সাংবাদিকটি তাকে বাধা দিয়ে বলল, এটি একটি নতুন পৃথিবী, এখানে অপরাধীরা মৃত্যুবরণ করেও পালিয়ে যেতে পারবে না।
কমবয়সী মেয়েটি পাথরের ওপর নিশ্চল হয়ে পড়ে থাকা রগারিজ ক্রুচিনের রক্তাক্ত মৃতদেহটির দিকে তাকিয়ে একটা ছোট নিশ্বাস ফেলল।
চিড়িয়াখানা
তোমাকে দেখার আমার একটু কৌতূহল ছিল– বলে হাজীব কুন্তেরা রাহান জাবিলের দিকে তাকিয়ে একটু হাসল। হাজীব কুন্তেরার চেহারায় বিচিত্র একধরনের নিষ্ঠুরতা রয়েছে। এই হাসিটি হঠাৎ করে সেই নিষ্ঠুরতাটিকে কেন জানি খোলামেলাভাবে প্রকাশ করে দিল।
রাহান জাবিল হঠাৎ করে একধরনের আতঙ্ক অনুভব করে, এই মানুষটির আমন্ত্রণ রক্ষা করে এখানে আসা হয়তো খুব বুদ্ধিমানের কাজ হয় নি। সে বেশ চেষ্টা করে মুখে একধরনের বেপরোয়া এবং শান্ত ভাব ধরে রেখে জিজ্ঞেস করল, কেন? আমাকে দেখার তোমার কৌতূহল কেন?
আমি পৃথিবীর সবচেয়ে ক্ষমতাশালী মানুষ। ইচ্ছে করলে আমি মাঝারি একটা দেশের রাষ্ট্রপতি পাল্টে দিতে পারি। আমাকে নিয়ে খবরের কাগজে রিপোর্ট লেখে সেই মানুষটি কেমন দেখার কৌতূহল।
আমি একজন সাংবাদিক। সত্যকে প্রকাশ রাহানের বক্তৃতাটি মাঝপথে থামিয়ে হাজীব কুন্তেরা বলল, থাক।
রাহান খানিকটা অপমানিত বোধ করে কিন্তু হঠাৎ করে যে–কোনো মূল্যে সত্যকে প্রকাশ করার সাংবাদিকদের পবিত্র দায়িত্ব সম্পর্কে বক্তৃতা দেওয়ার উৎসাহ হারিয়ে ফেলে।
হাজীব কুন্তেরা টেবিলে তার আঙুল দিয়ে শব্দ করতে করতে বলল, আমি যা ভেবেছিলাম তুমি ঠিক তাই।
রাহান ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল, সেটি কী?
কমবয়সী, অপরিপক্ক, নির্বোধ এবং আহাম্মক।
রাহান হতভম্ব হয়ে মানুষটির দিকে তাকিয়ে রইল। একজন মানুষ যত বিত্তশালীই হোক, যত ক্ষমতাবানই হোক, সে কি অন্য একজনের সাথে এই ভাষায় কথা বলতে পারে!
রাহান কিছু-একটা বলতে যাচ্ছিল, হাজীব আবার হাত তুলে তাকে থামিয়ে দিল, বলল, রাগ করো না। তোমার বয়সে আমিও নির্বোধ এবং আহাম্মক ছিলাম।
রাহান ক্রুদ্ধ গলায় বলল, আমি নির্বোধ এবং আহাম্মক নই।
হাজীব রাহানের কথার উত্তর না দিয়ে অত্যন্ত বিচিত্র ভঙ্গিতে হাসল এবং হঠাৎ করে রাহান বুঝতে পারল সে আসলেই নির্বোধ এবং আহাম্মক। সে খানিকক্ষণ একধরনের অক্ষম আক্রোশ নিয়ে হাজীবের সবুজ চোখের দিকে তাকিয়ে থাকে তারপর একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, তুমি কেন আমাকে ডেকে পাঠিয়েছ?
কথা বলার জন্যে।
রাহান ভুরু কুঁচকে বলল, কথা বলার জন্যে?
হ্যাঁ। আমার আসলে কথা বলার লোক নেই।
কথা বলার লোক নেই?
না। যারা আমার কর্মচারী তারা কখনো আমার চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলার সাহস পায় না। যারা পরিচিত তারা তোষামুদি করে।
তোমার আপনজন?
আমার কোনো আপনজন নেই।
রাহান ভুরু কুঁচকে বলল, আমি তোমার ওপর রিপোর্ট করেছি, আমি জানি তোমার দুইজন স্ত্রী আছে, তিনজন ছেলেমেয়ে আছে।
হাজীব এবারে শব্দ করে হাসল, এই হাসিটি হল শ্লেষে পরিপূর্ণ এবং সে-কারণে মানুষটিকে অত্যন্ত কুশ্রী দেখাল। রাহান মানুষটির মুখের দিকে তাকিয়ে একধরনের ঘৃণা অনুভব করে। হাজীব হাসি থামিয়ে বলল, আমার স্ত্রী এবং ছেলেমেয়ে প্রতিমুহূর্তে আমার মৃত্যু কামনা করে।