না। একজন পাগলা ডাক্তার থাকতেন–সেই পাগলা ডাক্তার খুন হয়ে যাবার পর থেকে এই অবস্থা।
ভেরি ইন্টারেস্টিং! জয়ন্ত দ্বীপটির দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, দেখে বোঝার উপায়ই নেই যে এটা হন্টেড। এতদিন শুধু হন্টেড হাউজ শুনে এসেছি, এখন দেখা যাচ্ছে হন্টেড আইল্যান্ড! আস্ত একটা দ্বীপ হন্টেড। পাগলা ডাক্তারের প্রেতাত্মা কন্ট্রোল করছে!
শ্রাবণী বলল, সবকিছু নিয়ে ঠাট্টা করবি না।
কে বলেছে আমি ঠাট্টা করছি? জয়ন্ত বিশেষ মনোযোগ দিয়ে খেতে খেতে বলল, আমি বলি কি, ফেরত যাওয়ার আগে এই হকুনদিয়া দ্বীপটা ইনভেষ্টিগেট করে যাই।
কেন?
আমি কখনো হন্টেড প্লেস দেখি নাই। এটা হচ্ছে সুযোগ। সত্যি কথা বলতে কি, পাগলা ডাক্তারের প্রেতাত্মাকে যদি একটা শিশির ভেতরে ভরে নিয়ে যেতে পারি_
শ্রাবণী বিরক্ত হয়ে বলল, বাজে কথা বলবি না।
ট্রলারটি হকুনদিয়া দ্বীপের খুব কাছে দিয়ে যাবার সময় তিনজনই খুব কৌতূহল নিয়ে সেদিকে তাকিয়ে রইল। তাদের কেউই জানত না আগামী আটচল্লিশ ঘণ্টার মাঝেই এই দ্বীপটিকে নিয়ে তাদের জীবনের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ঘটনাটি ঘটতে যাচ্ছে।
.
ট্রলারটি যখন গন্তব্যস্থলে পৌঁছেছে তখন বেলা গড়িয়ে এসেছে। নিয়াজ, জয়ন্ত আর শ্রাবণী বড় একটি রিলিফ–কাজের ছোট একটা অংশ হিসেবে এসেছে–কাজেই তাদের কোনো গুরুত্ব দেবে কিনা সেটা নিয়ে খুব সন্দেহের মাঝে ছিল–কিন্তু দেখা গেল তাদের আশঙ্কা অমূলক। বিশাল একটি বার্জ সমুদ্রের মাঝে নোঙর করে রাখা আছে। সেটি ঘিরে। নানারকম কর্মব্যস্ততা। অসংখ্য ট্রলার এবং নৌকা, কিছু ছোট লঞ্চ, বেশকিছু স্পিডবোট দাঁড়িয়ে আছে, তার মাঝে নানারকম রিলিফ–সামগ্রী তোলা হচ্ছে–লোকজনের হৈচৈ চেঁচামেচিতে একটা কর্মমুখর পরিবেশ কিন্তু তার ভেতরেই তিনজন পৌঁছানো মাত্রই তাদেরকে রিলিফ–কাজের দায়িত্বে যে–মানুষটি তার কাছে নিয়ে যাওয়া হল। ভদ্রলোক জাতিতে ব্রিটিশ, মধ্যবয়স্ক, চুলদাড়িতে পাক ধরেছে। রোদে পোড়া চেহারা। তাদেরকে দেখে ভারি খুশি হলেন। জরুরিভাবে যোগাযোগ করে এই জিনিসগুলো আনা হয়েছে– বোঝা গেল এগুলো ছাড়া রিলিফ ওয়ার্কের ওষুধপত্রে একধরনের অসংগতি থেকে যেত। ব্রিটিশ ভদ্রলোক ইংরেজিতে বললেন, তোমরা অনেক কষ্ট করে এসেছ, এখন বিশ্রাম নাও। বার্জের ওপরে তোমাদের থাকার ব্যবস্থা রয়েছে।
জয়ন্ত ইংরেজি মোটামুটি গুছিয়ে লিখতে পারে কিন্তু বলার সময় তার খানিকটা বাধো বাধো ঠেকে। তাই দিয়েই সে বলল যে তারা ট্রলারে শুয়ে–বসে এসেছে এবং মোটেও ক্লান্ত নয়। এই কথা শুনে সাথে সাথে তাদের কাজে লাগিয়ে দেওয়া হল, শারীরিক পরিশ্রম করার মতো অনেক মানুষ আছে, কিন্তু মোটামুটি লেখাপড়া জানে এখানে এরকম মানুষের খুব অভাব।
বার্জ থেকে নানা রিলিফ বের করে ট্রলার এবং নৌকায় তোলা হতে লাগল। ম্যাপে ছোট ছোট দ্বীপগুলো চিহ্নিত আছে। কোথায় কত মানুষ মারা গেছে কতজন ঘরবাড়ি হারিয়েছে, কী পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে লিখে রাখা আছে। ম্যাপ এবং লিস্ট দেখে জিনিসপত্রের পরিমাণ ঠিক করে চিরকুটে সংখ্যাটি লিখে দেওয়া হতে লাগল। সেটি দেখে মালপত্র বোঝাই করে ট্রলার–নৌকা–লঞ্চগুলো চলে যেতে রু করল। যেগুলো গিয়েছে সেগুলো ফিরে আসতে শুরু করেছে। সেখানে মালপত্র বোঝাই করে আবার তাদের নতুন জায়গায় পাঠানো হতে লাগল।
রিলিফ ওয়ার্কে আরো অনেকে এসেছে। একটা বড় অংশ এসেছে কিছু এনজিও থেকে। বিশ্ববিদ্যালয় আর কলেজের আরো কিছু ছাত্র এসেছে। ছাত্রী হিসেবে শ্রাবণীই একজন তবে ব্রিটিশ রিলিফ টিমের সাথে কয়েকজন মহিলা এসেছে। জয়ন্ত যদিও মুখ টিপে হেসে বলল, তারা শুধু নামেই মহিলা, দেখতে শুনতে আকারে এবং আকৃতিতে সবাই এই দেশের বড় সন্ত্রাসীর মতো!
সমস্ত কাজ শেষ করে ঘুমুতে ঘুমুতে গভীর রাত হয়ে গেল। বার্জের ডেকে সবার শোয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে, শুধু মেয়েদের আলাদা কেবিন দেওয়া হয়েছে। শ্রাবণীর কেবিনটি দেখে জয়ন্ত এবং নিয়াজের চোখ হিংসায় ছোট ছোট হয়ে গেল! ছোট বাংক বেড, মাথার কাছে গোল জানালা, ছোট খেলনার মতো একটা সিংক, লাগোয়া বাথরুম, সবকিছু ঝকঝক তকতক করছে। জয়ন্ত দেখে শুনে মুখ সুঁচালো করে বলল, তোরা না নারীবাদী মহিলা–আমাদেরকে শুকনো ডেকের মাঝে শুইয়ে রেখে নিজে এরকম কেবিন নিয়ে ঘুমুচ্ছিস যে?
আমি নিই নি। আমাকে দেওয়া হয়েছে।
ছুঁড়ে ফেলে দে। বলে দে থাকব না এখানে।
শ্রাবণী বক্তৃতা দেওয়ার ভঙ্গি করে বলল, যে জাতি নারীদের সম্মান করে না সেই জাতির উন্নতি হয় না। তোরাও শেখ।
.
পরের দিনটিও ব্যস্ততার মাঝে কাটল। বিকেলের দিকে তারা একটা দলের সাথে কাছাকাছি হোট একটা দ্বীপে রিলিফ নিয়ে গেল। তাদেরকে আসতে দেখে অনেক আগে থেকে মানুষজন ভিড় করে দাঁড়িয়ে রয়েছে। শুকনো অভুক্ত মানুষ ঘরবাড়ি ভয়ঙ্কর সাইক্লোন আর জলোচ্ছ্বাসে উড়ে গেছে। আগে থেকে খবর পেয়েছিল বলে নিরাপদ আশ্রয়ে গিয়ে অবিশ্যি বেশির ভাগ মানুষ প্রাণে বেঁচে গিয়েছে।
ফিরে আসার সময় আবার তারা হকুনদিয়া দ্বীপের অন্য পাশ দিয়ে ফিরে এল। গভীর অরণ্যে ঢেকে থাকা দ্বীপটি দূর থেকে খুব রহস্যময় মনে হয়। এখানে কোনো মানুষ নেই– কেউ গেলে সাথে সাথে মারা পড়ে চিন্তা করলেই কেমন জানি ভয় হয়।