জয়ন্ত নিজের নাম শুনে চোখ খুলে বলল, কী হয়েছে?
শ্রাবণী হেসে বলল, দেখলি খাবারের গন্ধে কীরকম জেগে উঠেছে?
খাবার! জয়ন্ত এবারে সত্যি সত্যি উঠে বসল, খাবারের কথা তো ভুলেই গিয়েছিলাম! কে এনেছে খাবার?
শ্রাবণী!
জয়ন্ত হাতে কিল দিয়ে বলল, ফ্যান্টাস্টিক! যা খিদে পেয়েছে কী বলব। বঙ্গোপসাগরের এই রুচিকর হাওয়ায় মনে হচ্ছে একটা আস্ত ঘোড়া খেয়ে ফেলতে পারব।
শ্রাবণী স্যান্ডউইচ বের করতে করতে বলল, সরি জয়ন্ত, তোর জন্যে আমি ঘোড়া রান্না করে আনি নি। স্যান্ডউইচ খেতে হবে।
বিপদে পড়লে বাঘে ঘাস খায়–আর এটা তো স্যান্ডউইচ।
শ্রাবণী কিছু খাবার আলাদা করে নিয়াজের হাতে দিয়ে বলল, এটা মাঝিকে দিয়ে আয়।
জয়ন্ত মাথা নেড়ে বলল, জব্বার মিয়া তোর এই আধুনিক খাবার খেতে পারবে না। শুঁটকি দিয়ে ভাত যদি থাকে দে।
বাজে বকিস না।
নিয়াজ হাতে করে স্যান্ডউইচ আর কলা নিয়ে ট্রলারের ছাদে হামাগুড়ি দিয়ে পিছনে এগিয়ে গিয়ে ডাকল, জব্বার মিয়া।।
জব্বার মিয়া মধ্যবয়সী মানুষ। দেখে মনে হয় জগতের কোনোকিছুতেই সে কখনো বিস্মিত হয় না। চোখেমুখে এক ধরনের শান্ত এবং পরিতৃপ্ত ভাব। নিয়াজের দিকে তাকিয়ে বলল, জে। শ্যালো ইঞ্জিনের প্রবল শব্দের জন্যে তাকে প্রায়ই চিৎকার করে কথা বলতে হয়।
নেন। স্যান্ডউইচ খান।
জব্বার মিয়া মুখে মনোরম একটা হাসি ফুটিয়ে বলল, আপনারা খান।
আমরা তো খাচ্ছি। আপনিও খান।
জায়গামতো পৌঁছে খাব। এখন থাক।
নিয়াজ ঠিক বুঝতে পারল না যে–মানুষটা খেতে চাইছে না তাকে পীড়াপীড়ি করা। উচিত হবে কিনা। সে ফিরে আসার জন্যে মাথা ঘুরিয়েই দেখতে পায় বহুদূরে হালকা ছায়ার মতো একটা দ্বীপ দেখা যাচ্ছে। সে জব্বার মিয়ার দিকে তাকিয়ে বলল, আমরা কি ঐখানে। যাচ্ছি?
জে না।
তাহলে কোথায় যাচ্ছি?
আরো দূরে।
আর কতক্ষণ?
জব্বার মিয়া সূর্যের দিকে তাকিয়ে কেমন জানি অনিশ্চিতের মতো বলল, এই তো আর কিছুক্ষণ।
কথাটার কোনো সুনির্দিষ্ট অর্থ নেই, তাছাড়া সময়ের অনুমান করার জন্যে যার সূর্যের দিকে তাকাতে হয় তার কাছে সময় সম্পর্কে সূক্ষ্ম কোনো সদুত্তর পাওয়ার কোনো সম্ভাবনাই নেই। নিয়াজ হামাগুড়ি দিয়ে আবার শ্রাবণী এবং জয়ন্তের কাছে ফিরে এসে বলল, জব্বার মিয়া তোর সাহেবি খাবার খাবে না।
শ্রাবণী বিরক্ত হয়ে বলল, বাজে কথা বলিস না। না খেলে না খাবে–তুই দিয়ে আয়।
নিয়াজ ইতস্তত করে বলল, ইয়ে খেতে চাইছে না–তাকে জোর করে–
শ্রাবণী নিয়াজের হাত থেকে খাবারগুলো নিয়ে বলল, পুরুষমানুষের জিনেটিক কোডিঙে কিছু গোলমাল আছে, কমনসেন্স কম। একজনকে খাবার দিলে সে না খায় কেমন করে?
শ্রাবণী ট্রলারের উপর দিয়ে হেঁটে পিছনে গিয়ে জব্বার মিয়ার হাতে খাবার ধরিয়ে দিয়ে ফিরে এল, জব্বার মিয়াকে আপত্তি করার কোনো সুযোগ পর্যন্ত দিল না। নিয়াজ এক ধরনের বিস্ময় নিয়ে শ্রাবণীর দিকে তাকিয়ে থাকে–মেয়েটির মাঝে এক ধরনের স্বতঃস্ফূর্ততা আছে
যেটা সে হাজার চেষ্টা করেও আয়ত্ত করতে পারবে না।
শ্রাবণী দূরে তাকিয়ে চিৎকার করে বলল, দ্যাখ কী সুন্দর একটা দ্বীপ!
দেখেছি।
কী নাম এটার? শ্রাবণী জব্বার মিয়াকে জিজ্ঞেস করল, জর ভাই এইটা কোন দ্বীপ?
হকুনদিয়া।
হকুনদিয়া? কী পিকিউলিয়ার নাম।
জে। আগে এটার নাম ছিল দিঘলদিয়া। এখন নাম হকুনদিয়া। উপরে হকুন উড়ে তাই নাম হকুনদিয়া!
শ্রাবণী একটা গল্পের খোঁজ পেয়ে জব্বার মিয়ার কাছে এগিয়ে গেল, শকুন ওড়ে?
জে। হকুন উড়ে।
কেন?
কোনো মানুষ যেতে পারে না। যেই যায় সেই মরে। মড়ার খোঁজে হকুন ওড়ে।
শ্রাবণী চোখ বড় বড় করে জব্বার মিয়ার দিকে তাকিয়ে রইল, যেই যায় সেই মরে?
জে। পাঁচ-ছয় বছর আগে পাগলা ডাক্তার খুন হওয়ার পর আর কেউ যেতে পারে না।
পাগলা ডাক্তার?
জে।
এখানে একজন পাগলা ডাক্তার থাকেন?
জব্বার মিয়া দাঁত বের করে হেসে বলল, আসলে পাগল ছিলেন না। এলাকার লোক মায়া করে ডাকত পাগলা ডাক্তার। বিজ্ঞান মতে গবেষণা করতেন। অনেক আলেমদার মানুষ ছিলেন।
খুন হলেন কেমন করে?
জব্বার মিয়া এই পর্যায়ে একটা লম্বা নিশ্বাস ফেলে দার্শনিকের মতো বলল, এইটা দুনিয়ার নিয়ম। যত ভালো মানুষ সব খুন হয়ে যায়। বদ মানুষেরা বেঁচে থাকে।
এতক্ষণে দ্বীপটি আরো কাছে চলে এসেছে, সবুজ গাছে ঢাকা। বড় বড় নারকেল গাছ উপকূলটিকে ঢেকে রেখেছে। এত সুন্দর একটা দ্বীপ সম্পর্কে কীরকম অশুভ একটি প্রচার। পাগলা ডাক্তার ভদ্রলোকটির জন্যে শ্রাবণী এক ধরনের সমবেদনা অনুভব করে। মানুষটি নিশ্চয়ই অন্যরকম ছিলেন, তা না হলে সবকিছু ছেড়েছুঁড়ে এরকম একটি নির্জন দ্বীপে কেউ জীবন কাটাতে আসে?
শ্রাবণী নিয়াজ আর জয়ন্তের কাছে ফিরে এসে বলল, এই দ্বীপটা দেখেছিস, কী সুন্দর!
নিয়াজ গোগ্রাসে স্যান্ডউইচ খেতে খেতে বলল, হু।
এখানে কোনো মানুষ থাকতে পারে না, গেলেই মারা পড়ে।
সত্যি?
জব্বার ভাই তো তাই বলল।
আর তুই বিশ্বাস করে বসে আছিস?
কেন বিশ্বাস করব না? দ্বীপের নাম পর্যন্ত পাল্টে ফেলেছে–আগে ছিল দিঘলদিয়া, এখন হয়ে গেছে হকুনদিয়া। হকুন মানে বুঝলি তো? শকুন।
জয়ন্ত এক কামড়ে কলার একটা বড় অংশ মুখে পুরে খেতে খেতে বলল, মানুষ গেলে কেন মারা পড়ে সেটা বলেছে?