জয়ন্ত সমুদ্রটাকে তার সিগারেটের এ্যাশট্রে হিসেবে ব্যবহার করে একটু ছাই ফেলে বলল, রিলিফ ওয়ার্কে গিয়ে যখন দেখবি মানুষ দুদিন ধরে না–খেয়ে আছে, গায়ে কাপড় নেই তখন এমনিতেই ক্যামেরা আর ক্যাসেট প্লেয়ারের কথা ভুলে যাবি।
ট্রলারের ছাদে তিনজন চুপ করে বসে রইল। গত সপ্তাহে এরকম সময়েই ভয়ঙ্কর একটা সাইক্লোন এই এলাকায় সবকিছু ধ্বংস করে দিয়েছে। টেলিভিশনে সেই ছবি দেখে কারো বিশ্বাস হতে চায় না বাতাসের মতো নিরীহ একটি জিনিস এরকম প্রলয়ঙ্কর ঘটনা ঘটিয়ে ফেলতে পারে। জয়ন্ত অন্যমনস্কভাবে তার সিগারেটে দুটো টান দিয়ে দুজনের দিকে তাকিয়ে বলল, বাই দা ওয়ে–তোদের দুজনকে থ্যাংকস। ছুটির মাঝে ফুর্তিফার্তা না করে আমার কথায় রিলিফ নিয়ে চলে এলি। একা একা এসব কাজে খুব বোরিং লাগে। আর বদমাইশ সাইক্লোনটা দেখ, হিট করার জন্যে কী একটা সময় বেছে নিল।
শ্রাবণী বলল, তুই কি ভেবেছিলি সাইক্লোন পঞ্জিকা দেখে দিনক্ষণ ঠিক করে আসবে?
না তা অবিশ্যি ভাবি নি। জয়ন্ত শ্রাবণীর দিকে তাকিয়ে বলল, আর শ্রাবণী তোকে স্পেশাল থ্যাংকস। পুরুষ মানুষকে রাজি করাতে পারি না, আর দুই মেয়ে হয়ে রিলিফ নিয়ে চলে এলি!
তোদের নিয়ে তো মহামুশকিল হল! শ্রাবণী অধৈর্য হয়ে বলল, মেয়ে আর ছেলে এই জিনিসটা মনে হয় এক সেকেন্ডের জন্যেও তোরা ভুলতে পারিস না।
কে বলে ভুলতে পারি না? জয়ন্ত ষড়যন্ত্রীর মতো মুখ করে বলল, আমরা তো তুলতেই চাই। তোরাই তো ভুলতে দিস না।
কখন আমরা তোকে তুলতে দেই না?
ঐ যে লজ্জাবনত কটাক্ষ, ব্ৰীড়াময়ী ভঙ্গি, লাস্যময়ী হাসি!
কী বললি? কী বললি তুই? আমি ব্ৰীড়াময়ী ভঙ্গি আর লাস্যময়ী হাসি দিই? ধাক্কা দিয়ে যখন পানিতে ফেলে দেব তখন লাস্যময়ী হাসি আর ব্রীড়াময়ী ভঙ্গির মজাটা টের পাবি। কচ্ছপ কপ করে কাঁচা খেয়ে ফেলবে।
ফর ইওর ইনফরমেশান ইওর হাইনেস শ্রাবণী–কচ্ছপ কখনো কাউকে কপ করে খেয়ে ফেলে না।
তোকে বলেছে!
নিয়াজ শ্রাবণী আর জয়ন্তের হালকা কথাবার্তায় মন দিতে পারছিল না। যতক্ষণ পর্যন্ত গন্তব্যে না পৌঁছাচ্ছে সে ঠিক স্বস্তি পাচ্ছে না। সমুদ্রের তয়ঙ্কর ঢেউয়ে ছোট ট্রলার উথালপাথাল হয়ে দুলবে এরকম একটা ভয় ছিল কিন্তু সেরকম কিছুই হয় নি, সমুদ্রটা একটা বড় দিঘির মতো শান্ত, কিন্তু তবুও সে বিশ্বাস করতে পারছে না। মনে হচ্ছে হঠাৎ করে কিছু–একটা ঘটে যাবে। সামনে দূরে কোনো–একটা দ্বীপ খুঁজতে খুঁজতে সে শুকনো গলায় বলল, আর কতক্ষণ যেতে হবে রে?
জয়ন্ত চোখ কপালে তুলে বলল, কতক্ষণ যেতে হবে মানে? মাত্র তো শুরু করলাম। এখনো কমপক্ষে চার ঘণ্টা।
চার ঘণ্টা!
হ্যাঁ। কেন? তোর ভয় লাগছে?
নিয়াজ দুর্বলভাবে হাসল, বলল, না, ঠিক ভয় না। নার্ভাস।
ধুর! নার্ভাস লাগার কী আছে? নিচে গিয়ে শুয়ে থাক।
শোয়ার জায়গা কই? টয়লেট পেপার দিয়ে ট্রলার বোঝাই করে রেখেছিস।
টয়লেট পেপার? জয়ন্ত হা হা করে হেসে বলল, টয়লেট পেপার তুই কোথায় দেখলি? ওগুলো হচ্ছে মেডিক্যাল সাপ্লাই।
আমাদের দেশের মানুষের ওরকম মেডিক্যাল সাপ্লাই কোনো কাজে লাগে না। তাদের দেশে যেগুলো কোনো কাজে আসে না সেগুলো এখানে রিলিফ নাম দিয়ে পাঠিয়ে দেয়।
সেটা ঠিকই বলেছিস। জয়ন্ত মাথা নেড়ে বলল, একবার বন্যার পর রিলিফ নিয়ে গেছি, ব্রিটিশ একটা অর্গানাইজেশন রিলিফ পাঠিয়েছে বাক্স খুলে দেখি ভিতরে সান ট্যানিং লোশন! মানুষকে বোঝাতেও পারি না জিনিসটা কী কাজে লাগে।
জয়ন্তের কথা শুনে শ্রাবণী আর নিয়াজ দুজনেই খানিকক্ষণ হাসল এবং তারপর খানিকক্ষণ পশ্চিমা দেশের মুণ্ডুপাত করল। জয়ন্ত তার সিগারেটের শেষ অংশটুকুতে একটা লম্বা টান দিয়ে তার গোড়াটা সমুদ্রে ফেলে দিয়ে ট্রলারের ছাদে লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ল। শ্রাবণী হাঁটুতে মুখ রেখে উদাস হয়ে বসে থাকে এবং নিয়াজ কিছু–একটা করে সময় কাটানোর জন্যে নিচে নেমে এল। তার ব্যাগে কিছু বই এবং কাগজপত্র আছে। সেগুলো দেখে সময় কাটাতে যায়।
মানব সভ্যতার বিকাশের ওপর গভীর জ্ঞানের একটা বই পড়ার চেষ্টা করে নিয়াজ বেশি সুবিধে করতে পারল না–তখন সে একটা রগরগে ডিটেকটিভ বই নিয়ে বসল। ওষুধের একটা বড় বাক্সের উপর পা তুলে দিয়ে ট্রলারের বেঞ্চে আধাশোয়া হয়ে সে দীর্ঘ সময় নিয়ে বইটা পড়ে প্রায় শেষ করে বাইরে তাকায়। চারদিকে এখনো সেই পানি। সবকিছুর যেরকম একটা সীমা থাকে, পানির বেলাতেও সেটা মনে হয় সত্যি, এত সুন্দর নীল দেখেও সে কেমন জানি হাঁপিয়ে উঠছে। নিয়াজ বইটা বগলে নিয়ে আবার ট্রলারের ছাদে উঠে এল। সেখানে জয়ন্ত লম্বা হয়ে শুয়ে সত্যি সত্যি ঘুমিয়ে পড়েছে, হঠাৎ করে গড়িয়ে পানিতে পড়ে
যায় ভেবে নিয়াজ রীতিমতো আঁতকে ওঠে। শ্রাবণী সেই একইভাবে পা দুলিয়ে উদাস উদাস মুখ করে বসে আছে, নিয়াজকে দেখে জিজ্ঞেস করল, খিদে পেয়েছে?
নিয়াজের খাওয়ার কথা মনেই ছিল না, কিন্তু শ্রাবণীর কথা শুনেই চট করে খিদে পেয়ে গেল, মাথা নেড়ে বলল, কিছু তো পেয়েছেই।
নিচে দ্যাখ আমার ব্যাগটা আছে। নিয়ে আয়। কয়টা স্যান্ডউইচ বানিয়ে এনেছি।
নিয়াজ শ্রাবণীর ব্যাগটা নিয়ে এল। ভেতরে প্লাস্টিকের বাক্সে স্যান্ডউইচ, কয়টা লাচ্ছু, কলা এবং কয়েকটা কোল্ড ড্রিংকস। দেখে নিয়াজের চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল, বলল, বাহ! এই দ্যাখ তুই যে সবসময় বলিস ছেলে আর মেয়ের মাঝে কোনো পার্থক্য নাই সেটা সত্যি নয়। তুই কি মনে করিস কখনো আমি কিংবা জয়ন্ত এভাবে গুছিয়ে খাবার আনতে পারতাম?