রন কিছু বলল না, গভীর মমতায় নিশির দিকে তাকিয়ে রইল। নিশি ব্যাকুল হয়ে রনের দিকে তাকাল, রন তাকে গভীর ভালবাসায় আলিঙ্গন করে বলল, নিশি, তোমার কাউকে খুন করতে হবে না। আমি তোমাকে রক্ষা করব নিশি।
কেমন করে তুমি আমাকে রক্ষা করবে?
রন কোনো কথা বলল না, গভীর মমতায় সে নিশির মুখে হাত বুলিয়ে বলল, এই যে। এইভাবে।
নিশি অনুভব করল রনের শক্ত দুটি হাত তার গলায় চেপে বসেছে, নিশি নিজেকে মুক্ত করার চেষ্টা করল কিন্তু পারল না। একবিন্দু বাতাসের জন্যে তার বুকের ভেতর হাহাকার করতে থাকে কিন্তু রনের হাত এতটুকু শিথিল হল না। নিশি বিস্ফারিত চোখে রনের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল, সেই মুখে কোনো ক্রোধ নেই, কোনো জিঘাংসা নেই, কোনো প্রতিহিংসা নেই। সেই মুখে গভীর বেদনা এবং ভালবাসা।
নিশির জন্যে ভালবাসা এবং পৃথিবীর জন্যে ভালবাসা।
বেজি
নিয়াজ ট্রলারের ছাদে বসে দেখল সমুদ্রের গাঢ় সবুজ উপকূলটি প্রথমে হালকা নীল হয়ে ধীরে ধীরে ঝাঁপসা হয়ে মিলিয়ে যাচ্ছে। যতক্ষণ উপকূলটা দেখা যাচ্ছিল ততক্ষণ মনে হচ্ছিল বুঝি বা তীরের সাথে একটি যোগাযোগ আছে। সেটি যখন অদৃশ্য হয়ে গেল তখন হঠাৎ নিয়াজ অসহায় অনুভব করতে থাকে। চারদিকে শুধু পানি আর পানি, তার মাঝে ছোট একটা ট্রলার টুকটুক করে এগিয়ে যাচ্ছে এই ব্যাপারটিকেই তার কেমন জানি অবাস্তব মনে হয়–চিন্তা সুলেই নিয়াজের পেটের ভেতরে পাক দিয়ে ওঠে। সে সাঁতার জানে না, পানি নিয়ে সব সময়েই তার ভেতরে একটা ভয়। তার চাপাচাপিতেই ট্রলারের সবার জন্যে লাইফ–জ্যাকেট রাখা হয়েছে কিন্তু হঠাৎ যদি কোনো কারণে ট্রলার ডুবে যায় তাহলে এই লাইফ-জ্যাকেট দিয়ে তারা কী করবে?
নিয়াজের পাশেই শ্রাবণী দুই হাঁটুতে মুখ রেখে দূরে তাকিয়ে ছিল। তার চোখেমুখে কেমন যেন একধরনের উদাসী ভাব। নিয়াজ নিচুগলায় জিজ্ঞেস করল, তোর ভয় লাগছে না তো?
শ্রাবণীর চোখমুখের উদাস ভাবটা কেটে সেখানে একটা তেজি ভাব ফুটে উঠল। গলা উচিয়ে বলল, তোদের ধারণা মেয়ে হলেই তার সব সময় ভয় লাগতে থাকবে?
নিয়াজ অপ্রস্তুত হয়ে বলল, না, না–তা না। আমার নিজের ভয় লাগছে তো তাই তোকে জিজ্ঞেস করছি। পানি দেখলেই আমার ভয় লাগে।
শ্রাবণী শব্দ করে হেসে বলল, কী বলছিস তুই? পানি দেখলে ভয় লাগে? পানির মতো এত সুন্দর জিনিস দেখে কেউ ভয় পায়? দ্যাখ তাকিয়ে দ্যাখ।
নিয়াজ তাকিয়ে দেখল, পানির রঙটি আশ্চর্যরকম নীল, চারদিকে যতদূর চোখ যায় সেই নীল পানি এবং এই নীল রঙটির মাঝে একটা অপূর্ব সৌন্দর্য লুকিয়ে আছে। সে মাথা নেড়ে বলল, তা ঠিক। সমুদ্রের পানির মাঝে কিছু একটা আছে। একটা অন্যরকম ব্যাপার। তীর থেকে একরকম আবার ওপর থেকে অন্যরকম।
আর তুই এই সুন্দর পানিকে ভয় পাচ্ছিস?
জয়ন্ত ছড়িয়ে বসে অনেকক্ষণ থেকে একটা সিগারেট ধরানোর চেষ্টা করছিল, বাতাসের জন্যে সুবিধে করতে পারছিল না, শেষ পর্যন্ত সফল হয়ে সিগারেটে একটা লম্বা টান দিয়ে বলল, মানুষের শরীরের সিক্সটি পার্সেন্ট হচ্ছে পানি– হিসাব করলে পা থেকে এই বুক পর্যন্ত আসে। সেই পানিকে তুই পছন্দ করিস না?
শ্রাবণী আবার শব্দ করে হেসে বলল, ওভাবে বলিস না তো! সিক্সটি পার্সেন্ট পানি বললেই মনে হয় শরীরের নিচের অংশটা পানিতে থলথল করছে!
জয়ন্ত নাক–মুখ দিয়ে ধোঁয়া বের করে হা হা করে হেসে বলল, আর সুঁই দিয়ে ছোট একটা ফুটো করলেই সব পানি লিক করে বের হয়ে ফাটা বেলুনের মতো চুপসে যাচ্ছে!
নিয়াজ মুখ কুঁচকে জয়ন্তের দিকে তাকিয়ে বলল, তুই এর মাঝে একটা সিগারেট ধরিয়ে ফেললি এই সুন্দর পরিবেশটাকে পলিউট করে দিলি? বাতাসটাকে বিষাক্ত করে দিলি?
জয়ন্ত সিগারেটে আরেকটা লম্বা টান দিয়ে বলল, দ্যাখ নিয়াজ তোকে আমি আমার লোকাল গার্জিয়ান বানাই নি যে বসে বসে আমার ওপর মাতবরি করবি। আর বাতাসের পলিউশনের কথা যদি বলিস তাহলে ঐ তাকিয়ে দেখ তোর এই ট্রলারের শ্যালো ইঞ্জিন থেকে কী পরিমাণ কালো ধোঁয়া বের হচ্ছে।
তাই বলে এই একবিংশ শতাব্দীর মানুষ হয়ে তুই সিগারেট খাবি? আমি বুঝতেই পারি না মেডিক্যালের একজন স্টুডেন্ট হয়ে সে কেমন করে সিগারেট খেতে পারে।
এটাকে বলে নেশা। সিগারেটে নিকোটিন বলে একটা বস্তু থাকে। সেটা রক্তের মাঝে মিশে গিয়ে স্নায়ুতে এক ধরনের আরাম দেয়। মেডিক্যালের একজন স্টুডেন্ট কেমন করে এই সহজ জিনিসটা জানে না আমি সেটাও বুঝতে পারি না।
শ্রাবণী একটা ছোট ধমক দিয়ে বলল, তোরা থামবি? দুই সতীনের মতো ঝগড়া করে দিলি দেখি!
সিগারেট খাওয়া এবং না–খাওয়ার তর্ক এত সহজে থামার কথা ছিল না কিন্তু ঠিক তখন তারা দেখতে পেল ট্রলারের পাশ দিয়ে বিশাল একটি সামুদ্রিক কচ্ছপ ভেসে যাচ্ছে। তিনজনই খানিকটা উত্তেজিত হয়ে এই বিশাল কচ্ছপটার দিকে তাকিয়ে রইল। শ্রাবণী বলল, ইস, সাথে ক্যামেরাটা থাকলে একটা ছবি নেওয়া যেত।
নিয়াজ বলল, নিয়ে এলি না কেন?
ভাবলাম যাচ্ছি রিলিফ ওয়ার্ক করতে–পিকনিক করতে তো আর যাচ্ছি না। পিকনিকে গেলেই না ক্যামেরা ক্যাসেট প্লেয়ার এসব নিয়ে যায়!
নিয়াজ বলল, এটা তো আর লোক–দেখানো ব্যাপার না যে সাথে ক্যামেরা নিতে পারব না! আসল কথা হচ্ছে সিনসিয়ারিটি। আন্তরিকতা।