নিশির ভয়–পাওয়া মুখের দিকে তাকিয়ে রন গভীর ভালবাসায় তাকে বুকের মাঝে টেনে নেয়। অপূর্ব রূপসী এই রমণীটিকে সে মাত্র তিনশত বছর আগে থেকে চেনে। ছেলেমানুষ সরল এই মেয়েটিকে তার বড় ভালো লাগে।
***
গভীর রাতে তীক্ষ্ণ সাইরেনের শব্দে নিশি চমকে জেগে উঠল। বিছানায় তার পাশে শূন্য জায়গা, রন আগেই উঠে গেছে। নিশি ভয়–পাওয়া গলায় ডাকল, রন। কোথায় তুমি?
জানালার কাছে ছায়ামূর্তির মতো রন দাঁড়িয়ে ছিল, বলল, এই যে, আমি এখানে।
কী হয়েছে রন? সাইরেন বাজছে কেন?
পৃথিবীর মানুষের এখন খুব বড় বিপদ নিশি।
কী হয়েছে? কেন বিপদ?
পৃথিবীর জনসংখ্যা আশঙ্কা–সীমা পার হয়ে গেছে।
পার হয়ে গেছে? নিশি আতঙ্কে চিৎকার করে বলল, পার হয়ে গেছে?
হ্যাঁ। শুনছ না বিপদের সাইরেন?
এখন কী হবে?
জনসংখ্যা কমাতে হবে।
কীভাবে কমাবে? কাকে কমাবে?
জানি না। যোগাযোগ মডিউল খুলে দেখি।
রন যোগাযোগ মডিউলের নিয়ন্ত্রণ স্পর্শ করতেই ঘরের ভেতরে একজন মানুষের হলোগ্রাফিক প্রতিচ্ছবি ভেসে এল। মধ্যবয়স্ক কঠোর চেহারার মানুষ, বুকের উপর চারটি লাল রঙের তারা দেখে বোঝা যায় সে নিয়ন্ত্ৰণবাহিনীর অত্যন্ত উচ্চপদস্থ কর্মচারী। মানুষটি কঠোর গলায় বলল, পৃথিবী আবার ভয়ংকর বিপদের মুখোমুখি। মানুষের একটি বিশেষ সংখ্যায় পৌঁছে গেলে পৃথিবী তাকে বহন করতে পারে না, একটি অপ্রতিরোধ্য বিপর্যয় দিয়ে পৃথিবীর জনসংখ্যা কমে আসে। আমরা সেই অপ্রতিরোধ্য বিপর্যয়ের ভেতর দিয়ে যেতে চাই না। সেই বিপর্যয় নিয়ন্ত্রণহীন এবং তার ভেতর থেকে বের হয়ে আসা খুব কঠিন।
পৃথিবীর মানুষের গড় বয়স দুই হাজার বছর। গত দুই সহস্রাব্দ পৃথিবীতে নতুন কোনো শিশুর জন্ম হয় নি। বিবর্তনের ভেতর দিয়ে কার্যকর প্রজাতির উঠে আসার ব্যাপারটি পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেছে। মানবজাতি প্রকৃতির সাথে যুদ্ধ করার উপযোগী নয়। মানুষ এখন দুর্বল এবং অথর্ব। এই অবস্থার পরিবর্তন করতে হবে।
অতীতে জনসংখ্যা যখনই আশঙ্কার সীমা অতিক্রম করেছে তখনই মানুষের সংখ্যা কমিয়ে নতুন শিশুর জন্ম দেওয়া হয়েছে। যারা পৃথিবী থেকে বিদায় নিতে ইচ্ছুক তাদের তালিকা করে পৃথিবী থেকে অপসারণ করা হয়েছে। সেই সংখ্যা অত্যন্ত অপ্রতুল হওয়ায় লটারির মাধ্যমে নির্বাচন করে মানুষকে হত্যা করতে হয়েছে। মানুষকে অত্যন্ত দ্রুত হত্যা করতে পারে এরকম ভাইরাস তৈরি করে সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে দিয়ে একবার এক তৃতীয়াংশ মানুষ কমিয়ে দেওয়া হয়েছিল কিন্তু অবস্থার দ্রুত অবনতি ঘটেছে, এখন এক তৃতীয়াংশ মানুষকে হত্যা করেও পৃথিবীকে রক্ষা করা যাবে না। এখন পৃথিবীর অর্ধেক মানুষকে কমিয়ে আনতে হবে। যেভাবেই থোক।
পৃথিবীর জনসংখ্যা কমানোর জন্যে এবার সম্পূর্ণ নতুন এবং কার্যকর একটি পদ্ধতি গ্রহণ করা হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে এই পদ্ধতি অবলম্বন না করা হলে মহাবিপর্যয় থেকে রক্ষা পাওয়ার কোনো উপায় নেই। পদ্ধতিটি অত্যন্ত সহজ। আজ রাতের জন্যে মানুষ হত্যাসংক্রান্ত বিধিনিষেধটি পৃথিবী থেকে তুলে নেওয়া হল। পৃথিবীর প্রত্যেকটি জীবিত মানুষ অন্য একজন মানুষকে পৃথিবী থেকে অপসারণ করবে। এই হত্যাকাণ্ডের জন্যে তাকে আইনের মুখোমুখি হতে হবে না, বরং সে পৃথিবীতে বসবাসের সুযোগ পাবে। তাকে যেন হত্যাকারে অপরাধবোধে ভুগতে না হয় সেজন্যে কাল ভোরের আগেই তার পুরো স্মৃতিকে অপসারিত করে দেওয়া হবে।
মানুষ হত্যা করা খুব সহজ ব্যাপার নয়। এর কার্যকর কয়েকটি পদ্ধতি সবাইকে জানিয়ে দেওয়া হচ্ছে। পদ্ধতিগুলি হচ্ছে–
নিশি চিৎকার করে যোগাযোগ মডিউলটি বন্ধ করে দিতেই ঘরের মাঝামাঝি বসে থাকা কঠোর চেহারার মানুষের হলোগ্রাফিক প্রতিচ্ছবিটি অদৃশ্য হয়ে গেল। নিশি উদভ্রান্তের মতো রনের দিকে তাকাল, বলল, এটা হতে পারে না। এটা কিছুতেই হতে পারে না।
রন বিষণ্ণ গলায় বলল, কিন্তু এটা হয়ে গেছে।
একজন মানুষ আরেকজন মানুষকে হত্যা করতে পারে না।
প্রয়োজনের খাতিরে মানুষ অনেকবার অন্য মানুষকে হত্যা করেছে। পৃথিবীর ইতিহাস হচ্ছে যুদ্ধের ইতিহাস। যুদ্ধের অর্থ হচ্ছে হত্যাকাণ্ড। পরিকল্পিত সুসংবদ্ধ হত্যাকাণ্ড!
নিশি ব্যাকুল হয়ে বলল, কিন্তু এটি তো যুদ্ধ নয়।
কে বলেছে যুদ্ধ নয়? মানবজাতির বেঁচে থাকার জন্যে এটিও এক ধরনের যুদ্ধ। এখানে মানুষ নিজেরা নিজেদের শত্রু। তাই এখন একে অন্যকে হত্যা করবে। মানুষকে যেন সেই হত্যাকাণ্ডের অপরাধবোধ বহন করতে না হয় সেজন্যে তার স্মৃতিকে পুরোপুরি অপসারণ করে দেওয়া হবে। সে জানতেও পারবে না সে একটি হত্যাকাণ্ডে অংশ নিয়েছে।
নিশি হিস্টিরিয়াগ্রস্তের মতো মাথা নেড়ে বলল, না–না–না। এটা হতে পারে না। কিছুতেই হতে পারে না। একজন মানুষ অন্যকে খুন করতে পারে না।
রন বিষণ্ণ গলায় বলল, এটি সেরকম খুন নয়। এর মাঝে কোনো ক্রোধ, জিঘাংসা, স্বার্থ বা লোভ নেই। এটি একটি প্রক্রিয়া, পৃথিবীকে বাঁচিয়ে রাখার একটি প্রক্রিয়া। মানুষকে বাচিয়ে রাখার একটি প্রক্রিয়া। এর সিদ্ধান্ত কোনো মানুষ নেয় নি, তারা শুধুমাত্র নিয়মটি পালন করছে।
নিশি এবারে মুখ ঢেকে আকুল হয়ে কেঁদে ফেলল, কাঁদতে কাঁদতে বলল, কিন্তু আমি কেমন করে একজন মানুষকে খুন করব? কাকে খুন করব? কেমন করে খুন করব?