বব রিকার্ডোকে বাধা দিয়ে একজন সাংবাদিক জিজ্ঞেস করল, তাহলে কিসে তাদের মৃত্যু হবে?
রোগ, শোক, একসিডেন্ট, প্রাকৃতিক বিপর্যয়, হত্যাকাণ্ড। কিন্তু পৃথিবীর হিসেবে সেটি অত্যন্ত ক্ষুদ্র। মানুষের যদি মৃত্যু না হয়, দেখতে দেখতে এই পৃথিবীতে জনসংখ্যার এক ভয়াবহ বিস্ফোরণ ঘটবে। এই পৃথিবীতে থাকবে শুধু মানুষ আর মানুষ। আজ থেকে হাজার। বছর পর এই পৃথিবীতে পদচারণা করবে সহস্র বছরের যুবা, তাদের চোখে কী থাকবে–স্বপ্ন হতাশা আমি জানি না, তাদের বুকে কী থাকবে, ভালবাসা না ঘৃণা সেটাও আমি জানি না। আমার বয়স সত্তর, আমি এখনো আমার শৈশবকে স্মরণ করতে পারি, সহস্র বছরের মানুষ কি তার শৈশবকে স্মরণ করতে পারবে? আমার মনে হয় পারবে না। তাদের স্মৃতিতে কোনো আনন্দ নেই, তাদের সামনে ভবিষ্যৎ নেই, কোনো স্বপ্ন নেই। বেঁচে থাকার কোনো তাড়না নেই। তাদের সমাজে কোনো শিশু নেই, কোনো ভালবাসা নেই তাদের কথা চিন্তা করে আমি শিউরে উঠছি।
একজন প্রৌঢ় সাংবাদিক জিজ্ঞেস করলেন, তাহলে আপনি কি মনে করেন ড. আলবার্তো গার্সিয়াকে পৃথিবীর ইতিহাস ভালোভাবে স্মরণ করবে না?
বব রিকার্ডো বিষণ্ণমুখে মাথা নেড়ে আলবার্তো গার্সিয়ার দিকে তাকালেন, বললেন, আমি দুঃখিত আলবার্তো। কিন্তু আমার ধারণা মানব সভ্যতাকে ধ্বংস করার জন্যে পৃথিবীর ইতিহাস এককভাবে তোমাকে দায়ী করবে। তুমি হবে পৃথিবীর ইতিহাসের সবচেয়ে বড় অভিশপ্ত বিজ্ঞানী।
আলবার্তো গার্সিয়া ফ্যাকাসে মুখে বব রিকার্ডোর দিকে তাকিয়ে রইলেন।
***
দুই হাজার বছর পরের কথা।
.
নিশি রনের গলা জড়িয়ে বলল, তুমি এরকম মুখ ভার করে আছ কেন?
রন অন্যমনস্কভাবে নিশির হাত সরিয়ে বলল, কে বলেছে আমি মুখ ভার করে আছি?
এই তো আমি দেখছি, তুমি নিজ থেকে কোনো কথা বলছ না, আমি কিছু জিজ্ঞেস করলে উত্তর দিচ্ছ। তাও ছাড়া ছাড়াভাবে, কাটা কাটাভাবে।
রন নিশিকে নিজের কাছে টেনে এনে বলল, আমি দুঃখিত নিশি। কয়দিন থেকে কেমন যেন অস্থির অস্থির লাগছে।
কেন? কী হয়েছে?
জানি না কেন। আমার বয়স প্রায় দুই হাজার বছর হয়ে গেছে কিন্তু এখনো মনে হয় নিজেকে বুঝতে পারি না।
নিশি রনের গলা জড়িয়ে খিলখিল করে হেসে বলল, তোমার বয়স দশ হাজার বছর হলেও তুমি নিজেকে বুঝতে পারবে না। কিছু কিছু মানুষ নিজেকে বুঝতে পারে না।
রন কোমল চোখে নিশির মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি কি নিজেকে বুঝতে পার?
নিশি মাথা নাড়ল, বলল, পারি। এই যেমন মনে কর তোমার পাশে বসলেই আমার মনে হয় আমার বয়স এক হাজার বছর কমে গিয়েছে?
সত্যি?
সত্যি।
রন মাথা নাড়ল, বলল, আমি বিশ্বাস করি না। এক হাজার বছর আগে তোমার কেমন লাগত সেটি তোমার মনে নেই। তোমার মনে থাকার কথা নয়।
নিশি হাসি হাসি মুখে বলল, মনে না থাকলে নেই–সবকিছু মনে রাখতে হবে তোমাকে কে বলেছে?
আমার মাঝে মাঝে খুব মনে করার ইচ্ছে করে। রন এক ধরনের উদাস–চোখে বলল, আমার কোন জিনিসটা সবচেয়ে বেশি মনে করার ইচ্ছে করে জান?
কোন জিনিসটি?
আমার শৈশবের কথা। আমি শৈশবে কী করেছি খুব জানার ইচ্ছে করে।
সেটি তুমি কেমন করে জানবে? গত দুই হাজার বছরে তুমি নিশ্চয়ই তোমার স্মৃতি খুব কম করে হলে পাঁচবার মুছে দিয়েছ।
নিশ্চয়ই। নিশ্চয়ই দিয়েছি।
তুমি যতবার তোমার নতুন জীবন শুরু করেছ ততবার তুমি তোমার স্মৃতি মুছে দিয়েছ।
রন মাথা নাড়ল, আমার নতুন জীবনটি কতটুকু নতুন কে জানে!
নিশি খিলখিল করে হেসে বলল, অ্যাডভেঞ্চারের দিকে তোমার যত ঝোঁক আমি নিশ্চিত তুমি এক দুইবার ছেলে থেকে মেয়ে হয়েছ, মেয়ে থেকে ছেলে হয়েছ! দুই হাজার বছরে তো কত কী করা যায়!
রন কোনো কথা না বলে একটু হাসল। নিশি হঠাৎ মুখ গম্ভীর করে বলল, আমার কী ইচ্ছে করে জান?
কী?
আমার খুব সন্তানের মা হতে ইচ্ছে করে। এরকম ছোট একটা বাচ্চা হবে, আঁকুপাকু করে নড়বে, আমি বুকে চেপে ধরে রাখব, ভাবলেই আমার বুকের ভিতর কেমন জানি করতে থাকে।
রন নিশিকে স্নেহভরে কাছে টেনে নিয়ে বলল, তুমি খুব ভালো করে জান সেটি হবার নয়। পৃথিবীতে নতুন শিশুর জন্ম দেওয়া বন্ধ হয়ে গেছে প্রায় এক হাজার বছর আগে।
জানি। তবুও ইচ্ছে করে।
পৃথিবী যত মানুষকে বাচিয়ে রাখতে পারে এখানে তার থেকে অনেক বেশি মানুষ। আমার শুধু কী মনে হয় জান?
কী? পৃথিবীতে জনসংখ্যা আবার বুঝি আশঙ্কা–সীমা পার হয়ে গেছে।
নিশি চমকে উঠে বলল, কী বলছ তুমি!
হ্যাঁ। মনে নেই গত কয়েক মাস থেকে খাবার পরিবহনে ত্রুটি দেখা দিয়েছে, পানীয়ের সরবরাহ কম।
হ্যাঁ।
আমার ধারণা এগুলো পরিবহনের বা সরবরাহের ক্রটি নয়।
নিশি ভয়–পাওয়া গলায় বলল, তাহলে এগুলো কী?
এগুলো অভাব। শুধু যে খাবারের অভাব তাই নয়, জ্বালানির অভাব, জায়গার অভাব। তুমি লক্ষ করেছ আমাদের এই দুই হাজার তলা দালানে একটি এপার্টমেন্ট খালি নেই? দেখেছ?
হ্যাঁ। দেখেছি।
মনে আছে পোশাকের মূল্য শতকরা বিশভাগ বাড়ানো হল। মনে আছে?
নিশি মাথা নাড়ল, তার মনে আছে। রন গম্ভীরমুখে বলল, আমার এইসব দেখে মনে হয় কী জান?
জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের একটা ব্যবস্থা নেওয়া হবে?
হ্যাঁ।
নিশির বুক কেঁপে ওঠে, পৃথিবীতে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের জন্যে গত দুই হাজার বছরে বেশ কয়েকবার ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, সেই স্মৃতি তাদের মস্তিষ্ক থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে, কিন্তু তবু তারা সেগুলো জানে। পৃথিবীর মানুষ এখন এই ভয়াবহ আতঙ্ক নিয়ে বেঁচে থাকে, কখন পৃথিবীর প্রয়োজনে তাকে পৃথিবী থেকে অপসারণ করিয়ে দেওয়া হয়।