বৃদ্ধ অধ্যাপক বব রিকার্ডো শেষ পর্যন্ত উঠে দাঁড়ালেন, তাকে নির্দিষ্ট সময়ের মাঝে সেশনটি শেষ করার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। যদি এখনই তিন নিয়ন্ত্রণটুকু হাতে না নিয়ে নেন সেটি সম্ভব হবার কথা নয়। বব রিকার্ডোকে উঠে দাঁড়াতে দেখে শ্রোতারা তাদের করতালি থামিয়ে একজন একজন করে নিজের চেয়ারে বসে পড়লেন, সাংবাদিকদের দলটি ঠেলাঠেলি করে আরো সামনে এসে ভিড় করে দাঁড়াল। বব রিকার্ডো কী বলেন সোনার জন্যে সবাই নীরব হয়ে অপেক্ষা করতে থাকে।
বব রিকার্ডো উপস্থিত শ্রোতাদের দিকে তাকিয়ে একটি নিশ্বাস ফেলে কোমল গলায় বললেন, আলবার্তো গার্সিয়ার নাম আমাদের মতো কয়েকজন ছাড়া কেউ জানত না। কিন্তু আজ থেকে পৃথিবীর সব মানুষ আলবার্তোর কথা জানবে। আজকের কনফারেন্সে সে যে পেপারটি উপস্থাপন করেছে আপাতদৃষ্টিতে মনে হবে সেটি অত্যন্ত সাদামাটা একটি টেকনিক্যাল পেপার, কোষ–বিভাজনের সময় মানব–ক্রমোজমের টেলোমিয়ারকে অক্ষত। রাখার প্রক্রিয়া। কিন্তু একটু খুঁটিয়ে দেখলেই দেখা যাবে সে শুধু টেলোমিয়ারকে অক্ষত রাখে নি, টেলোমারেজ প্রক্রিয়াটি বিশ্লেষণ করেছে এবং সফলভাবে মানবকোষে ব্যবহার করেছে। আমরা তার তথ্য থেকে জানতে পেরেছি আলবার্তোর সাদাসিধে একটি ল্যাবরেটরিতে একটি পেটরি–ডিশে মানবদেহের ত্বকের কয়েকটি কোষ বিভাজন করছে যাদের থেমে যাওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই।
বব রিকার্ডো বার্ধক্যে শীর্ণ হয়ে যাওয়া তার হাতটি সামনে তুলে ধরে বললেন, আমাকে বার্ধক্য এবং জরা আক্রান্ত করেছে, কারণ প্রকৃতির নিয়ম অনুযায়ী আমার দেহের কোষগুলো তাদের হিসাবমতো এক শ থেকে দু শ বারের মতো বিভাজন করে থেমে পড়ছে। মঞ্চে দাঁড়ানো আলবার্তো বলছে থেমে পড়ার প্রয়োজন নেই। আলবার্তো গার্সিয়া মানবজাতির পক্ষ থেকে সৃষ্টিজগতের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তথ্যটি খুঁজে বের করেছে। সে আজ আপনাদের সামনে ঘোষণা করেছে মানুষকে বার্ধক্য স্পর্শ করবে না। বব রিকার্ডো হঠাৎ থেমে গেলেন, কয়েক মুহূর্ত ইতস্তত করে বললেন, প্রকৃতপক্ষে আলবার্তো মানুষকে অমরত্ব দান করেছে।
হলঘরটিতে হঠাৎ একধরনের চাঞ্চল্য দেখা গেল, একসাথে অনেকে কথা বলতে শুরু করল, অনেকে প্রশ্ন করার জন্যে উঠে দাঁড়াল। বব রিকার্ডো হাত তুলে সবাইকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, আমি জানি আপনাদের সবার ভিতরে অসংখ্য প্রশ্ন জমা হয়েছে, আমার নিজের ভিতরেও আছে। কিন্তু আজকে আমাদের হাতে সময় নেই, আমি এখানে মাত্র অল্প দু–একটি প্রশ্ন গ্রহণ করতে পারব। কে প্রশ্ন করতে চান?
উপস্থিত বিজ্ঞানীদের অনেকেই হাত তুলে প্রায় দাঁড়িয়ে গেলেন। বব রিকার্ডো তাদের। একজনকে সুযোগ দেওয়ার জন্যে ইঙ্গিত করছিলেন কিন্তু তার আগেই কমবয়সী একজন তরুণী হাতে মাইক্রোফোন নিয়ে দাঁড়িয়ে গেল; অনুমতির অপেক্ষা না করেই বলল, প্রফেসর রিকার্ডো–আমরা সংবাদপত্র থেকে এসেছি, আপনাদের বৈজ্ঞানিক আলোচনা আমরা কিছুই বুঝব না। সেটি কি করে করা যায় না? আপাতত আমাদের কৌতূহল মেটানোর জন্যে কি একটি-দুটি প্রশ্নের উত্তর দেওয়া যায় না?
বব রিকার্ডো একটু হাসার চেষ্টা করে বললেন, কী প্রশ্ন?
তরুণীটি আরো একটু এগিয়ে এসে বলল, আমি ডক্টর গার্সিয়ার কাছে জানতে চাই। তিনি কেন এই আবিষ্কারটি করেছেন?
আলবার্তো গার্সিয়াকে একটু বিভ্রান্ত দেখা গেল, তিনি প্রশ্ন দৃষ্টিতে তরুণী সাংবাদিকের দিকে তাকিয়ে বললেন, কেন?
হ্যাঁ, কেন?
আলবার্তো গার্সিয়া একটু বিপন্ন মুখে বললেন, টেলোমারেজ নিয়ে আমার অনেকদিনের কৌতূহল। আমাদের ল্যাবরেটরিতে সেরকম সুযোগ–সুবিধে নেই, তাই যেটুকু পেরেছি সেটুকুই করেছি। মানবকোষকে কীভাবে অনির্দিষ্ট সময় বিভাজন করতে দেওয়া যায় সেটি বিজ্ঞানীমহলে দীর্ঘদিনের কৌতূহল। আমি সেই কৌতূহল থেকে কাজ করেছি
কিন্তু মানুষ যদি অমর হয়ে যায়–তাদের যদি মৃত্যু না হয়।
আলবার্তো গার্সিয়া হাত তুলে থামিয়ে দিয়ে বললেন, আমি একজন বিজ্ঞানী, আমি শুধুমাত্র বিজ্ঞানের কৌতূহল নিয়ে কাজ করেছি। এই তথ্যের কারণে মানবসমাজে কী প্রভাব পড়বে সে–সম্পর্কে আমার বিন্দুমাত্র ধারণা নেই।
তরুণী সাংবাদিক উৎকণ্ঠিত মুখে বলল, কিন্তু এখন আমরা সেটাই শুনতে চাই। মানুষ যদি অমর হয়ে যায়, এই পৃথিবীর কী হবে? সমাজের কী হবে?
আলবার্তো গার্সিয়া মাথা নাড়লেন, বললেন, আমি জানি না। একমুহূর্ত চুপ করে থেকে তিনি বব রিকার্ডোর দিকে ঘুরে তাকিয়ে বললেন, হয়তো প্রফেসর রিকার্ডো এ ব্যাপারে আপনাদের কিছু একটা বলতে পারবেন।
সাংবাদিকরা সাথে সাথে বব রিকার্ডোর দিকে ঘুরে গেল, প্রফেসর রিকার্ডো, আপনি কি কিছু বলবেন?
বব রিকার্ডো কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, ভবিষ্যৎ অনুমান করা খুব কঠিন, কিন্তু তোমরা যদি আমাকে চাপ দাও আমি চেষ্টা করতে পারি।
আমরা চাপ দিচ্ছি প্রফেসর রিকার্ডো।
বব রিকার্ডো একটু হেসে কথা বলতে শুরু করলেন, কথা শুরু করার সাথে সাথে তার মুখের হাসি মিলিয়ে সেখানে একটি থমথমে গাম্ভীর্য চলে এল। প্রায় নিচুগলায় বললেন, মানুষের অমরত্বের জন্যে মোহ দীর্ঘদিনের। এই অমরত্বের লোভে সেই প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে অনেক অন্যায় অনেক পাপ করা হয়েছে। দেবদেবী বা ঈশ্বর মানুষকে যে অমরত্ব দিতে পারে নি, আমাদের বিজ্ঞানীরা মানুষকে সেই অমরত্ব দেওয়ার আয়োজন সম্পন্ন করেছেন। এখনো সেই কাজ পূর্ণ হয় নি কিন্তু আমার হিসেবে আগামী শতাব্দী থেকে মানুষ আর বাধক্যের কারণে মৃত্যুবরণ করবে না।