যাই হোক, একটি রোষ্ট্রনকে পালিয়ে যেতে সাহায্য করার জন্যে শাস্তি হিসেবে আপনাকে একটি তথ্য জানানো হবে। তথ্যটির বীভৎসতা আপনার মস্তিষ্কে পাকাপাকিভাবে থেকে যাবে, যার প্রতিফল হিসেবে আপনার সুদীর্ঘ নিদ্রা একটি সুদীর্ঘ দুঃস্বপ্নে পরিণত হবে বলে আমরা বিশ্বাস করি। আপনাকে ইতোপূর্বে বলা হয়েছিল যে আপনাকে নিয়ে মহাকাশযানটি এক অভিযানে যাবে, সেখানে কোনো-এক কারণে আপনার মৃত্যু ঘটবে এবং আপনার মৃতদেহ পৃথিবীতে ফিরিয়ে আনা হবে। কথাটি আক্ষরিক অর্থে সত্যি নয়। আপনাকে একটি গ্রহপুঞ্জের কাছাকাছি নিয়ে যাওয়া হবে। সেখানে কোনো কারণে আপনার একটি পরিবর্তন হবে, সেই পরিবর্তন এত ভয়াবহ যে আপনার জন্যে সেটি মৃত্যুর সমতুল্য। আপনি আর আপনি থাকবেন না, আপনার সেই পরিবর্তিত অবস্থাকে পৃথিবীতে ফিরিয়ে আনা হবে। আপনার যে-শারীরিক এবং মানসিক পরিবর্তন ঘটবে, সেটি সাধারণ মানুষের জন্যে উপলব্ধি করা কঠিন, কোনো সুস্থ মানুষকেই সেই মিশনে রাজি করানো সম্ভব নয় বলে আপনাকে সেখানে পাঠানো হচ্ছে। রবোট্রনকে পালাতে সাহায্য করেছেন বলে তার শাস্তি হিসেবে আপনাকে সেই পরিবর্তন এখন চাক্ষুষ দেখানো হবে। আপনার ঠিক এই ধরনের একটি পরিবর্তন ঘটবে, সেই চিন্তাটুকু আপনার মস্তিষ্কে স্থিতিশীল হওয়ার পর আপনি ঘুমিয়ে পড়বেন। আপনি আপনার সুদীর্ঘ নিদ্রায় এই দুঃস্বপ্নটুকু সহ্য করে অপরাধের প্রায়শ্চিত্ত করবেন। ধন্যবাদ।
লোকটির ভাবলেশহীন মুখ স্ত্রীন থেকে সরে গিয়ে সেখানে একজন ঘুমন্ত মানুষের চেহারা ভেসে উঠল, আমার মতো কোনো-একজন দুর্ভাগ্যবান ব্যক্তি। একটি যান্ত্রিক গলার স্বর পরিষ্কার স্বরে বর্ণনা দেয়া শুরু করে, ইনি রুকুল গ্রহপুঞ্জের অভিযাত্রী, গ্রহপুঞ্জের দুই লক্ষ মাইল পৌছানোর ঠিক আগের অবস্থা। সমস্ত শারীরিক ও মানসিক অবস্থা পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণাধীন।
একটু পরেই লোকটির চেহারায় অস্বস্তি ও কষ্টের ভঙ্গি ফুটে ওঠে, ধীরে ধীরে তার সারা শরীরে এক ধরনের অস্থিরতা ছড়িয়ে পড়ে। যান্ত্রিক গলার স্বর জানিয়ে দিল লোকটি গ্রহপুঞ্জের দুই লক্ষ মাইলের ভেতর পৌছে গেছে। এর পরের পরিবর্তন অত্যন্ত ধীরে ধীরে হয়েছে এবং পুরো পরিবর্তনটুকু শেষ হতে প্রায় এক সপ্তাহের মতো সময় লেগেছে, কিন্তু আমাকে সেটি এক নিমিষের ভেতরে দ্রুত দেখিয়ে দেয়া হবে।
সেই দুঃসহ বীভৎস দৃশ্য আমার পক্ষে সহ্য করা সম্ভব নয়, কিন্তু মানুষের ধৈর্যের সীমা যে কতদূর বিস্তৃত করা যায় সেটিও আমার জানা ছিল না। লোকটি ধীরে ধীরে একটা কুৎসিত অমানুষিক আকারে রূপ নিল, আমার দেখা কোনো প্রাণী বা সরীসৃপের সাথেই তার মিল নেই, মানুষ কল্পনাতেও এ ধরনের কোনো জীবের কথা কল্পনা করতে পারে না। সেই ভয়াবহ জীবটি ক্ষুদ্র ক্যাপসুলে ছটফট করছিল, সেটি যন্ত্রণার না সুখের অভিব্যক্তি আর বোঝার উপায় নেই।
আমি চোখ বন্ধ করে চিৎকার করে উঠতে চাইলাম, কিন্তু চিৎকার দেয়া দূরে থাকুক, আমার চোখের পাতা পর্যন্ত নাড়ানোর ক্ষমতা নেই, ঘুমিয়ে না পড়া পর্যন্ত সেই বীভৎস দৃশ্য আমাকে দেখতে হবে—এর থেকে আমার কোনো মুক্তি নেই।
হঠাৎ আমার সমস্ত অনুভূতি শিথিল হয়ে আসতে থাকে, আমি বুঝতে পারলাম আস্তে আস্তে আমি গভীর ঘুমে ঢলে পড়ছি। আমার শেষ ঘুম, এই ঘুম থেকে আমি আর জাগব না, কিন্তু কী বীভৎস একটি দৃশ্য আমার চোখের সামনে। আমার ভেতরে কে যেন হঠাৎ বিদ্রোহ করে ওঠে, চিৎকার করে বলে ওঠে, আমি ঘুমাব না, এই বীভৎস দৃশ্য নিয়ে আমি ঘুমাব না, কিছুতেই ঘুমাব না। আমার শেষ মুহূর্তে আমি সুন্দর কিছু চাই, মধুর কিছু চাই—আর সেই মুহূর্তে আমার সেই সুন্দরী মেয়েটির কথা মনে পড়ে। আমার হাত স্পর্শ করে আমার দিকে একাগ্র চোখে তাকিয়েছিল, অপূর্ব সুন্দর দুটি চোখ আর সেই চোখে বিস্ময়, শঙ্কা আর তার সাথে সাথে কী গাঢ় বিষাদ! কী নাম মেয়েটির? জিজ্ঞেস করা হয় নি, আহা—আর কোনোদিন তার নাম জানা হবে না!
পরমুহূর্তে আমি ঘুমের অতলে তলিয়ে গেলাম।
০৪. অনাহুত আগন্তুক
৪. অনাহুত আগন্তুক
কিম জুরান, কিম জুরান।
খুব ধীরে ধীরে কেউ একজন আমার নাম ধরে ডাকল। গলার স্বরটি আমি আগে শুনেছি, কিন্তু কার ঠিক ধরতে পারছি না।
উঠুন কিম জুরান।
আমি কোথায়? ঘুমুচ্ছি আমি? আমার মনে পড়ল এক জোড়া অপূর্ব সুন্দর চোখ আমার দিকে তাকিয়ে আছে, গাঢ় বিষাদ সেই চোখে, কিন্তু চোখগুলো মিলিয়ে একটা বীভৎস প্রাণী হাজির হয়েছে, সেই প্রাণীটির দিকে তাকিয়ে আমিও আস্তে আস্তে পাল্টে যাচ্ছি, বীভৎস একটা সরীসৃপ হয়ে যাচ্ছি আমি, আতঙ্কে আমি চিৎকার করছি, কিন্তু কেউ আমার কথা শুনছে না!
কিম জুরান, উঠুন। আপনার ঘুম ভেঙে গেছে, আপনি চোখ খুলে তাকান।
আমি কোথায়? খুব ধীরে ধীরে আমার সব কথা মনে পড়ে, আমি এক মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামী, আমাকে এক মহাকাশযানে করে পাঠানো হয়েছে শাস্তি হিসেবে। আমি হঠাৎ চমকে উঠি, আমার ঘুম ভেঙে গেছে, তাহলে কি আমি পৌছে গেছি রুকুন গ্ৰহপুঞ্জে? আমি কি এখন পাল্টে যাব এক কুৎসিত সরীসৃপে? কিন্তু আমার তো ঘুম ভাঙার কথা নয়, আমার তো ঘুমিয়েই থাকার কথা। তাহলে কি এটাও স্বপ্ন?
কিম জুরান, চোখ খুলুন।
আমি চোখ খুললাম, কফিনের মতো সেই ক্যাপসুলে আমি শুয়ে আছি, ভেতরে হালকা আলো, মিষ্টি একটা গন্ধ ছড়িয়ে আছে।