মেয়েটা খানিকটা বিস্ময়, খানিকটা দুর্ভাবনা নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে রইল। নিরাপত্তা বাহিনীর লোকটা এগিয়ে এসে বলল, কী বলছে ফিসফিস করে?
মেয়েটা তার কথার উত্তর না দিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে রইল, আমি দেখতে পেলাম তার মুখ আস্তে আস্তে গাঢ় বিষাদে ঢেকে যাচ্ছে।
আমি একটা নিঃশ্বাস ফেলে চোখ বন্ধ করে ফেলি।
আমাকে যে, ক্যাপসুলটার ভেতরে শুইয়ে পাঠানো হবে সেটিকে দেখে কফিনের কথা মনে পড়ে। সেটি কফিনের মতো লম্বা এবং কালো রঙের, ক্যাপসুলটি কফিনের মতোই অস্বস্তিকর। হাজারো ধরনের ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতিতে ক্যাপসুলটা ভরা, এই যন্ত্রপাতি আমাকে সুদীর্ঘ সময় ঘুম পাড়িয়ে নিয়ে যাবার দায়িত্ব পালন করবে। আমি একটা শক্ত চেয়ারে বসেছিলাম, আমাকে ঘিরে বিভিন্ন লোকজন ব্যস্তভাবে হাঁটাহাঁটি করছে, শেষবারের মতো নানা যন্ত্রপাতি টিপেটুপে পরীক্ষা করছে। জানালা দিয়ে বাইরে দেখা যায়, নানা আকারের, নানা আকৃতির মহাকাশযান ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে, একটিদু’টি থেকে সাদা ধোঁয়া বের হচ্ছে, সেগুলোর কোনো-একটিতে করে আমাকে পাঠানো হবে, ঠিক কোন মহাকাশযানটি আমার জন্যে প্রস্তুত করা হচ্ছে, সেটা নিয়েও আমি কোনো কৌতূহল অনুভব করছিলাম না। আমার সমস্ত অনুভূতি কেমন যেন শিথিল হয়ে আসছিল। অপেক্ষা করতে আর ভালো লাগছিল না, মনে হচ্ছিল যত তাড়াতাড়ি সবকিছু শেষ হয়ে যায় ততই ভালো।
একসময়ে আমাকে নিয়ে ক্যাপসুলে শোয়ানো হল, বাইরে থেকে বোঝা যায় না, কিন্তু ভেতরটা অত্যন্ত আরামদায়ক, আমার শরীরের মাপে মাপে তৈরি বলেই হয়তো। একটি শ্যামলা রঙের মেয়ে খুব যত্ন করে আমার শরীরের বিভিন্ন জায়গায় মনিটরগুলো লাগিয়ে দিচ্ছিল। প্রত্যেকবার আমার চোখে চোখ পড়তেই সে একবার মিষ্টি করে হাসছিল। মেয়েটি সম্ভবত একজন নার্স, তাকে সম্ভবত শেখানো হয়েছে প্রয়োজনেঅপ্রয়োজনে হাসতে, তার হাসি সম্ভবত পেশাদার নার্সের মাপা হাসি, কিন্তু তবু আমার বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হচ্ছিল এটি সহৃদয় আন্তরিক হাসি।
সবকিছু শেষ হতে প্রায় পঁয়তাল্লিশ মিনিটের মতো সময় লেগে গেল। তিন-চার জন বিভিন্ন ধরনের লোকজন সবকিছু পরীক্ষা করার পর ক্যাপসুলের ঢাকনাটা ধীরে ধীরে নামিয়ে দেয়া হল। ভেবেছিলাম সাথে সাথে বুঝি কবরের মতো নিকষ কালো অন্ধকার নেমে আসবে, কিন্তু তা হল না, কোথায় জানি খুব কোমল একটা বাতি জ্বলে উঠে ক্যাপসুলের ভেতর আবছা আলো ছড়িয়ে দেয়। খুব ধীরে ধীরে ভেতরে একটা মিষ্টি গন্ধ ভেসে আসতে থাকে। খুব চেনা একটা গন্ধ, কিন্তু কিসের ঠিক ধরতে পারলাম না, ভেতরের বাতাস নিশ্চয়ই সঞ্চালন করা শুরু হয়েছে। মাথার কাছে একটা স্ক্রীন ছিল জানতাম না, এবারে সেটা ধীরে ধীরে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে, এটিতে নিশ্চয়ই কিছু-একটা দেখা যাবে। ভেতরের নীরবতাটুকু যখন অসহ্য হয়ে উঠতে শুরু করল, ঠিক তক্ষুণি কোথা থেকে জানি খুব মিষ্টি একটা সুর বেজে ওঠে।
কতক্ষণ পার হয়েছে জানি না, এক মিনিটও হতে পারে, এক ঘন্টাও হতে পারে, ক্যাপসুলের ভেতর সময়ের আর কোনো অর্থ নেই। আমার একটু তন্দ্রামতো এসে যাচ্ছিল, নিশ্চয়ই কোনো-একটা ওষুধের প্রতিক্রিয়া, এরকম অবস্থায় তন্দ্রা আসার কথা নয়। হঠাৎ সামনের স্ক্রীনে একটা লোকের চেহারা ভেসে ওঠে, লোকটি মধ্যবয়স্ক, মাথার কাছে চুলে পাক ধরেছে। ভাবলেশহীন মুখ, কাঁধের কাছে দু’টি লাল তারা দেখে বুঝতে পারলাম অনেক উচ্চপদস্থ লোক। লোকটি কোনোরকম ভূমিকা না করেই কথা বলা শুরু করে দিল, বলল, আপনার মৃত্যুদণ্ডাদেশ পালন করার এটি হচ্ছে শেষ পর্যায়। আর পাঁচ মিনিটের ভেতর আপনি ঘুমিয়ে পড়বেন, আপনাকে যে-ওষুধ দেয়া হয়েছে সেটা কাজ শুরু করতে এর থেকে বেশি সময় লাগার কথা নয়। ঘুমিয়ে পড়ার সাথে সাথেই আপনার স্বাভাবিক জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটবে। যদিও দুঃখজনক, তবু এটি অস্বীকার করার উপায় নেই যে আপনার জীবন তুলনামূলকভাবে সংক্ষিপ্ত, কারণ মানুষ হিসেবে আপনার পৃথিবীর প্রতি যে-দায়িত্ব ছিল আপনি সেটি সুচারুভাবে পালন করেন নি। কিন্তু এই মুহূর্তে সেটি নিয়ে আপনার প্রতি কেন্দ্রীয় কাউন্সিলের কোনো অভিযোগ নেই, তার কারণ আপনাকে আপনার উপযুক্ত শাস্তি দেয়া হয়েছে। বেআইনিভাবে ক্রুগো কম্পিউটারে প্রবেশ করার জন্যে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড, আপনি সেটা পেয়েছেন। মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামী হয়েও আপনি একটি রবোট্রনকে পালিয়ে যেতে সাহায্য করেছেন, তার জন্যে আপনাকে কিছু অতিরিক্ত শাস্তি ভোগ করতে হবে। আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি, তার শাস্তি হিসেবে আপনার আসন্ন নিদ্রাকে একটি যন্ত্রণাদায়ক অভিজ্ঞতা হিসেবে পরিবর্তিত করে দেব।
না, আমি পাগলের মতো চিৎকার করে উঠি, তোমাদের কোনো অধিকার নেই; কোনো অধিকার নেই।
আমি অবাক হয়ে দেখলাম, আমার গলা দিয়ে একটি শব্দও বের হল না, আমি ঝটকা মেরে উঠে বসতে চাইলাম, কিন্তু লাভ হল না, আমার সমস্ত শরীর অবশ হয়ে এসেছে, আমি আমার আঙুল পর্যন্ত নাড়াতে পারছি না।
লোকটি একঘেয়ে গলায় আবার কথা বলতে শুরু করে, আমাদের যন্ত্রপাতি বলছে আপনি কিছু-একটা করার চেষ্টা করছেন। আপনাকে সম্ভবত বলে দিতে হবে না যে, আপনাকে যে-ওষুধ দেয়া হয়েছে তার প্রতিক্রিয়া হিসেবে আপনার এখন দেখা, শোনা এবং চিন্তা করা ছাড়া আর সবরকম শারীরিক প্রক্রিয়া পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেছে। আপনাকে যেটুকু জিনিস বলার কথা এবং যে-জিনিসটি দেখানোর কথা, সেটি বলে এবং দেখিয়ে দেবার সাথে সাথে আপনি পুরোপুরি ঘুমিয়ে পড়বেন।