বলুন, আপনি রবোট্রনটিকে ছেড়ে দিয়েছেন কেন?
আমি ওকে ছাড়ি নি, ও নিজেই পালিয়ে গিয়েছিল।
কিন্তু ও পালানোর সুযোগ পেয়েছে, কারণ আপনি লাল কার্ড দেখিয়ে ওকে সরিয়ে নিয়ে গেছেন।
আমি কাঁধ ঝাকিয়ে তার কথা মেনে নিলাম, এটা কোনো প্রশ্ন নয়, তাই আমি উত্তর দেবার প্রয়োজন বোধ করলাম না। লোকটি তবু উত্তরের জন্যে বসে রইল, বলল, বলুন।
কী বলব?
কেন তাকে ছাড়িয়ে নিলেন?
আমার মায়া হচ্ছিল, মেয়েটাকে যেভাবে মারা হল সেটা ছিল অমানুষিক নিষ্ঠুরতা।
মায়া? নিষ্ঠুরতা? লোকটা পারলে চেয়ার থেকে লাফিয়ে ওঠে। আমার পাশে যে ডাক্তার মেয়েটি দাঁড়িয়ে ছিল তার দিকে তাকিয়ে বলল, শুনেছেন কী বলেছে?
ডাক্তার মেয়েটি দেখতে বেশ, আমার জন্যে খানিকটা সমবেদনা আছে টের পাচ্ছি। লোকটার কথার উত্তর না দিয়ে কাঁধ ঝাঁকাল। লোকটি আবার রাগ-রাগ মুখে আমার দিকে তাকায়, রবোট্রনের জন্যে মায়া হয়? একটা পেন্সিল ভাঙলে মায়া হয় না?
লোকটি নিজের কথাকে আরো বেশি বিশ্বাসযোগ্য করার জন্যেই সম্ভবত তার হাতের পেন্সিলটি ভেঙে ফেলল।
ডাক্তার মেয়েটি প্রথম বার কথা বলল, আপনি খামোকা উত্তেজিত হচ্ছেন। পেন্সিল আর রবোট্রন এক জিনিস নয়। রবোট্রন দেখতে এত মানুষের মতো যে তাদের ধ্বংস করতে দেখা খুব কষ্টকর, মনে হয় মানুষ হত্যা করা হচ্ছে। আমরা আগেও দেখেছি, অনেকে রবোট্রন ধ্বংস করা সহ্য করতে পারে না।
লোকটি এবার রাগ-রাগ মুখে ডাক্তার মেয়েটির মুখের দিকে তাকাল, রবোট্রনেরা কী করছে সেটা যদি সবাই জানত, তাহলে সহ্য করা নিয়ে খুব সমস্যা হত না। ক্রুগো কম্পিউটারের শেষ রিপোর্টটা দেখেছেন?
দেখেছি। তাহলে?
কিন্তু ক’জন ঐ রিপোর্টের খোঁজ রাখে? আর ঐ রিপোর্টের সব সত্যি, তার কি নিশ্চয়তা আছে?
লোকটি ভুরু কুঁচকে ডাক্তার মেয়েটির দিকে তাকাল, আপনি বলতে চান ক্রুগো কম্পিউটার একটা মিথ্যা রিপোর্ট লিখবে?
মেয়েটি উত্তর না দিয়ে আবার কাঁধ ঝাঁকাল। লোকটি খানিকক্ষণ চিন্তিত মুখে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে থেকে আমার দিকে ঘুরে তাকাল। আস্তে আস্তে প্রায় শোনা যায় না এরকম স্বরে বলল, আপনি জানেন, আপনি যে কাজটি করেছেন তার শাস্তি কী?
আমি এবারে সত্যি সত্যি মধুর ভঙ্গি করে হেসে বললাম, জানি।
কী?
মৃত্যুদণ্ড।
লোকটার চোখ ছোট ছোট হয়ে এল, আপনি ভাবছেন আপনাকে যখন ইতোমধ্যে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছে আপনার আর ভয় কী? মানুষকে তো আর দু বার মারা যায় না।
যায় নাকি? আমি সত্যিই কৌতূহল নিয়ে জিজ্ঞেস করলাম।
লোকটার মুখে একটা ধূর্ত হাসি ফুটে ওঠে। বলে, না, তা যায় না। কিন্তু একটা মৃত্যু অনেক রকমভাবে দেয়া যায়।
আমি ভেতরে ভেতরে শঙ্কিত হয়ে উঠলেও বাইরে সেটা প্রকাশ না করে মুখে জোর করে একটা শান্তভাব বজায় রাখার চেষ্টা করতে থাকি। লোকটা আমার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে ছিল, আমি তার চোখের দিকে তাকিয়ে থেকে জিজ্ঞেস করি, কিন্তু আমাকে আর কীভাবে কষ্ট দেয়া হবে? আমাকে মহাকাশযানে ওঠানোর আগে ঘুম পাড়িয়ে দেয়ার কথা।
হ্যাঁ। ঘুম পাড়িয়ে দেয়া হবে, কিন্তু ঠিক ঘুম পাড়ানোর আগে আপনাকে একটা যন্ত্রণা দিয়ে ঘুম পাড়ানো যায়, আপনার মস্তিষ্কে সেটা রয়ে যাবে। আপনার সুদীর্ঘ ঘুম তখন একটা সুদীর্ঘ যন্ত্রণা হয়ে যাবে, তার থেকে কোনো মুক্তি নেই।
লোকটা ঘনিষ্ঠ বন্ধুর মতো দাঁত বের করে হাসে। কিছু কিছু লোক এত নিষ্ঠুর কেন হয় কে জানে?
অজানা একটা আশঙ্কায় হঠাৎ আমার বুকের ভেতর ধক করে ওঠে। আমার লুকাসের কথা মনে পড়ল, এজন্যেই কি সে আমাকে শেষ করে দিতে চেয়েছিল? আগামীকাল আমার জীবনের শেষদিন বলে ভাবছিলাম, সেটা কি আসলে আরেক দুঃসহ যন্ত্রণার শুরু?
লোকটা উঠে দাঁড়ায়, আপনাকে ঠিক কী করা হবে জানি না। সেটা বড় বড় হর্তাকর্তারা ঠিক করবেন। এখন আপনার পরীক্ষাগুলো সেরে নিই।
লোকটা ডাক্তার মেয়েটার দিকে তাকিয়ে বলল, আপনি আপনার কাজ শুরু করতে পারেন, আমার কাজ আপাতত শেষ।
ডাক্তার মেয়েটি আমাকে পাশের ঘরে এনে ধবধবে সাদা একটা উচু বিছানায় শুইয়ে দিল। উপরে একটা বাতি ছিল, মেয়েটি বাতিটা টেনে নিচে নামিয়ে আনে। আমি মেয়েটির মুখের দিকে তাকিয়ে প্রথমবার অনুভব করি মেয়েটি অপূর্ব সুন্দরী, আমার বুকের ভেতর হঠাৎ একটা আশ্চর্য কষ্ট হতে থাকে। ভালবাসার জন্যে বুভুক্ষু হৃদয় হঠাৎ হাহাকার করে ওঠে। আমার চোখে চোখ পড়তেই মেয়েটি একটু হেসে আমার হাত আস্তে স্পর্শ করে বলল, আপনি ভয় পাবেন না, আপনার ভয়ের কিছু নেই।
নিরাপত্তা বাহিনীর লোকটি এগিয়ে এসে বলল, কী বললেন আপনি?
বলেছি, ভয়ের কিছু নেই।
ভয়ের কিছু নেই। তাই বলেছেন আপনি? লোকটি হঠাৎ উচ্চস্বরে হেসে ওঠে, আপনি বলেছেন তার ভয়ের কিছু নেই? আমি ওর জায়গায় হলে এখন একটা চাকু এনে নিজের গলায় বসিয়ে দিতাম!
লোকটি শুধু যে নিঠুর তাই নয়, তার ভেতরে সাধারণ ভব্যতাটুকও নেই। ডাক্তার মেয়েটি তাকে পুরোপুরি উপেক্ষা করে আমার হাত ধরে দৃঢ়স্বরে বলল, আমার কথা বিশ্বাস করুন, আপনার ভয় নেই।
আমি বিশ্বাস করেছি।
আমি আস্তে আস্তে মেয়েটার হাত স্পর্শ করে বললাম, আমাকে একটা যন্ত্রণা দিয়ে ঘুম পাড়ানো হবে। ঠিক ঘুমানোর আগে আমি তোমার কথা ভাবতে থাকব, আমার যন্ত্রণা তাহলে অনেক কমে যাবে।
মেয়েটি কিছু না বলে আমার দিকে ঝুঁকে এল। আমি ফিসফিস করে বললাম, আমার খুব সৌভাগ্য যে জীবনের শেষ মুহূর্তে এসে তোমার মতো একটা মেয়ের সাথে দেখা হল। তোমাকে আগে কেউ বলেছে যে তুমি কত সুন্দরী?