যন্ত্রণাটা আবার ফিরে আসবে ভেবেই ভয়ে আমার সারা শরীর শীতল হয়ে আসে। দুর্বল গলায় জিজ্ঞেস করলাম, আমি কীভাবে ফিরে যাব?
ট্যাক্সিটি কম্পিউটার কন্ট্রোলে দিয়ে দিলে নিজেই চলে যাবে, সময় একটু বেশি লাগবে, কিন্তু পৌছে যাবেন।
আমি তাহলে যাই। আবার যন্ত্রণাটা আসার আগেই পৌঁছে যেতে চাই।
লুকাস ম্লান হেসে মাথা নাড়ল, আমি খুব দুঃখিত, আপনাকে সাহায্য করতে পারলাম না।
আমার ভাগ্য!
লুকাস একটু ইতস্তত করে বলল, আপনার মৃত্যুদণ্ড কবে কার্যকর করবে আপনি জানেন?
আক্ষরিক অর্থে জানি না, তবে জানি। মৃত্যুদণ্ডটা একটু অন্যরকম, একটি মহাকাশযানে ঘুম পাড়িয়ে তুলে দেয়া হবে, যখন ফিরে আসব তখন দেখা যাবে আমি মৃত।
লুকাসের চোখ দুটি বিস্ময়ে বড় বড় হয়ে যায়, রবোট্রনেরা মানুষের ভাবভঙ্গি এত অবিকল অনুকরণ করতে পারে যে না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন! তার খানিকক্ষণ সময় লাগে ধাতস্ত হতে, ফ্যাকাসে মুখে আস্তে আস্তে বলে, আপনার মহাকাশযানটি কি কাল সন্ধ্যায় রওনা দিচ্ছে?
হ্যাঁ।
সর্বনাশ!
কী হয়েছে?
লুকাস শক্ত মুখে বলল, আপনাকে সাংঘাতিকভাবে প্রতারণা করা হয়েছে।
কী রকম? আমাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছে, মৃত্যু থেকে বেশিকিছু তো হতে পারে!
পারে। লুকাস পাথরের মতো মুখ করে বলল, পারে, মৃত্যু থেকেও ভয়ানক জিনিস হতে পারে।
হঠাৎ সে ছটফট করে ট্যাক্সি থেকে নেমে পড়ে, বাইরে একটু পায়চারি করে যখন ফিরে আসে তখন তার হাতে উদ্যত রিভলবার, আমার মাথার দিকে তাক করে বলল, আপনাকে আমি এখনই গুলি করে শেষ করে দেব, আপনাকে তাহলে মহাকাশযানে করে যেতে হবে না।
ট্রিগার টিপতে গিয়ে লুকাস থেমে গেল, আমার দিকে একটু ঝুঁকে এসে বলল, আমাকে ভুল বুঝবেন না। আপনি জানেন না, কিন্তু আমি আপনার একটা মস্তবড় উপকার করছি, আপনি আমার প্রাণ বাঁচিয়েছেন, আমি আপনার সাথে মিথ্যা কথা বলব না।
আমি হতবাক হয়ে লুকাসের চোখের দিকে তাকিয়ে ছিলাম, তাকে বাধা দেবার ক্ষমতা নেই। লুকাস স্থির চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আবার রিভলবার তুলে ধরল।
সেই মুহূর্তে একটা প্রচণ্ড বিস্ফোরণের আওয়াজ হল। বিস্ফোরকের ধোঁয়ার গন্ধ পেলাম আমি, আর অবাক হয়ে দেখলাম লুকাসের হাত কবজির কাছ থেকে ছিড়ে উড়ে গেছে। লুকাস খপ করে নিজের কাটা হাতটা ধরে বিকৃত মুখে কী-একটা বলে চেচিয়ে ওঠে, কেউ-একজন নিশ্চয়ই তাকে গুলি করেছে। দূরে পুলিসের গাড়ি দেখা যাচ্ছে, শব্দ শুনে বুঝতে পারলাম একটা হেলিকপ্টারও আছে উপরে কোথাও।
পারলাম না, আমি পারলাম না, লুকাস কাটা হাতটা বিদায়ের ভঙ্গিতে নেড়ে ছুটে গেল দেয়ালের দিকে। সামনে পুলিসের গাড়ি থেকে আবার তাকে গুলি করা হল, প্রচণ্ড বিস্ফোরণের আওয়াজ হল, কিন্তু তার গায়ে গুলি লাগল কিনা বুঝতে পারলাম না। ধোয়া সরে গেলে দেখতে পেলাম লুকাস তখনো ছুটছে, দেয়ালের পাশে গিয়ে এক লাফে সে প্রায় বিশ ফুট উচু দেয়ালে উঠে গেল, উপরে বৈদ্যুতিক তারগুলো ধরে সে নিজেকে মুহূর্তের জন্যে সামলে নেয়। বৈদ্যুতিক তারে তিরিশ থেকে চল্লিশ হাজার ভোন্ট থাকার কথা, কিন্তু লুকাসের কাছে সেটা কোনো সমস্যা বলে মনে হল না। আবার পুলিসের গাড়ি থেকে লুকাসকে গুলি করা হল, গুলির আঘাতে লুকাসকে দেয়ালের অন্য পাশে ছিটকে পড়ে যেতে দেখলাম, নিচে খাড়া খাদ অন্তত দুই শ’ ফুট নেমে গেছে, কপাল খারাপ হলে হাজারখানেক ফুট হওয়াও বিচিত্র নয়। মানুষ হলে বেঁচে থাকার কোনো প্রশ্নই আসত না, কিন্তু রবোটেরা, বিশেষ করে এই আশ্চর্য রবোট্রনেরা কতটুকু আঘাত সহ্য করতে পারে বলা কঠিন। গুলিটা কোথায় লেগেছে কে জানে, হয়তো এমন জায়গায় লেগেছে যে বেশি ক্ষতি হয় নি, হয়তো সামলে নেবে। আমি নিজের অজ্ঞাতেই প্রার্থনা করতে থাকি লুকাস যেন ঠিকঠিকভাবে পালিয়ে যেতে পারে।
পুলিসের গাড়িটি সাইরেন বাজাতে বাজাতে আমার ট্যাক্সির পাশে এসে দাঁড়াল। একজন পুলিস অফিসার ধীরেসুস্থে নেমে দেয়ালটার দিকে এগিয়ে যায়। আরেকজন হাতের চৌকোনা বাক্সে কার সাথে জানি কথা বলতে বলতে আমার দিকে এগিয়ে আসতে থাকে। কাছে এসে ট্যাক্সির জানালা দিয়ে মাথা ঢুকিয়ে আমার দিকে সহৃদয়ভাবে হেসে জিজ্ঞেস করল, কি খবর আপনার?
আমি উত্তরে ভদ্রতাসূচক কিছু-একটা বলতে যাচ্ছিলাম, ঠিক তক্ষুণি দ্বিতীয় বার ট্রাকিওশানটি চালু করা হল। এক মুহূর্তে আমার সারা শরীর যন্ত্রণায় কুঁকড়ে ওঠে, মনে হতে থাকে কেউ যেন গনগনে গরম সুচ আমার লোমকূপ দিয়ে শরীরে ঢুকিয়ে দিচ্ছে। মাথার ভেতরে কেউ যেন গলিত সীসা ঢেলে সমস্ত অনুভূতি আচ্ছন্ন করে দিল। আমি গাড়ির সীটটি খামচে ধরে প্রাণপণে যন্ত্রণা সহ্য করার চেষ্টা করলাম, নিজের অজান্তে আমার গলা দিয়ে বীভৎস গোঙানোর মতো আওয়াজ বের হতে থাকে। আমার মনে হয় অনন্তকাল থেকে আমি যেন ওখানে পড়ে আছি। অনেক কষ্টে আমি চোখ খুলে তাকালাম, পুলিস অফিসারটি তখনো মুখে হাসি নিয়ে আমাকে দেখছে।
আমার কিছু করার নেই, অসহায়ভাবে যন্ত্রণা সহ্য করা ছাড়া আর কিছু করার নেই।
০৩. শাস্তি
৩. শাস্তি
আপনি রবোট্রনটিকে ছেড়ে দিয়েছেন কেন?
এই নিয়ে আমাকে চতুর্থ বার একই প্রশ্ন করা হল। একটি প্রাচীন রবোট বা নির্বোধ কম্পিউটারের কাছ থেকে এরকম জিজ্ঞাসাবাদে আমি অবাক হতাম না, কিন্তু যে আমাকে জিজ্ঞাসাবাদ করছে সে একজন জলজ্যান্ত মানুষ। আগেও দেখেছি নিরাপত্তা বাহিনীর লোকজন কেমন জানি একচক্ষু হরিণের মতো হয়, নিজেদের বাঁধাধরা নিয়মের বাইরে কিছু দেখলে সেটা কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারে না।