ট্যাক্সি ড্রাইভার হঠাৎ গতিবেগ কমিয়ে বলল, সামনে একটা পুলিসের গাড়ি আমাদের থামতে বলছে।
লুকাস মুখ না তুলে বলল, ভান কর তুমি থামতে যাচ্ছ, কিন্তু থেমো না, শেষ মুহূর্তে গতিবেগ বাড়িয়ে তিন শ কিলোমিটার করে ফেলবে।
কিন্তু–
লুকাস পকেট থেকে একটা মাথা-লম্বা রিভলবার বের করে তার মাথায় কীএকটা জিনিস পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে লাগাতে থাকে। ট্যাক্সি ড্রাইভার সেটা দেখে আর উচ্চবাচ্য করার সাহস পায় না। গতিবেগ কমিয়ে এনে ঠিক থামার পূর্ব মুহূর্তে হঠাৎ করে গতি বাড়িয়ে দিয়ে গুলির মতো বের হয়ে গেল।
লুকাস আস্তে আস্তে বলল, চমৎকার!
পুলিসের গাড়িটি সঙ্গত কারণেই পিছু নেয়ার চেষ্টা করল। লুকাসকে বিচলিত মনে হল না, খানিকক্ষণ পুলিসের গাড়িটি লক্ষ করে হাতের বড় রিভলবারটি তুলে গুলি করে। হাততালির মতো একটা শব্দ হল, আমি দেখতে পেলাম পুলিসের গাড়িটি ঝাঁকুনি দিয়ে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেছে, গাড়ির ড্রাইভার প্রাণপণে সামলে নিয়ে রাস্তার পাশে গাড়িটা দাঁড় করানোর চেষ্টা করছে।
লুকাস পকেট থেকে চৌকোনা বাক্স বের করে তাতে কী—সব সংখ্যা প্রবেশ করিয়ে কয়েকটা লিভার টেনে একটা মিটার লক্ষ করতে থাকে। আমি জিনিসটি চিনতে পারলাম, রাডারকে ফাঁকি দেবার একটা প্রাচীন যন্ত্র, রাডারের প্রতিফলিত মাইক্রোওয়েভের কম্পনের সংখ্যা কমিয়ে অবস্থান সম্পর্কে ভুল তথ্য দেয়া হয়। এটি
যে এখনো ব্যবহার করা হয় আমার ধারণা ছিল না।
আমি কৌতূহল নিয়ে লুকাসের কাজকর্ম লক্ষ করতে থাকি। নিপুণ দক্ষ হাত, আশ্চর্য রকম শান্ত। এত রকম উত্তেজনার মাঝেও তার এতটুকু বিচলিত হবার লক্ষণ নেই। সবকিছু পরীক্ষা করে সন্তুষ্ট হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, আপনার কি কোনো ধরনের সাহায্যের দরকার?
তুমি কী ধরনের সাহায্যের কথা বলছ?
আপনি আমার প্রাণ বাঁচিয়েছেন, আমি আপনার প্রাণ বাঁচানোর কথা ভাবছিলাম।
আমার বুকে রক্ত ছলাৎ করে ওঠে, চমকে তার দিকে তাকালাম, সে কি সত্যি বলছে? সে কি জানে না আমার হৃৎপিণ্ডে একটা ট্রাকিওশান বসানো আছে, যেই মুহূর্তে ক্রুগো কম্পিউটার থেকে সেটা চালিয়ে দিয়ে একটা বিশেষ তরঙ্গ বের করতে শুরু করবে; আমার নিজের উপর কোনো নিয়ন্ত্রণ থাকবে না। নিয়ন্ত্রণকক্ষ থেকে একটা সুইচ ঘুরিয়ে আমাকে মেরে ফেলতে পারে, আমাকে মেরে না ফেলে শুধু অসহনীয় যন্ত্রণা দিতে পারে কিংবা ইচ্ছা করলে চিরদিনের মতো বোধশক্তিহীন একটা জড় পদার্থে পরিণত করে ফেলতে পারে।
আমি কী ভাবছিলাম লুকাস অনুমান করতে পারে; তাই আমার দিকে তাকিয়ে বলল, আপনি আপনার ট্রাকিওশানের কথা ভাবছেন?
হ্যাঁ।
আমি সেটা বের করে ফেলার কথা ভাবছিলাম।
সেটা সম্ভব?
এই মুহূর্তে সেটা সম্ভব নয়, কারণ আমার কাছে ঠিক যন্ত্রপাতি নেই। কিন্তু আপনাকে আমাদের কোনো-একটা জায়গায় নিতে পারলে চেষ্টা করে দেখতে পারতাম। চেষ্টা করে দেখব?
দেখ।
আগেই বলে রাখছি, সময় খুব কম। সাফল্যের সম্ভাবনা শতকরা দুই ভাগেরও কম।
আমি বুঝতে পারছি।
লুকাস হঠাৎ সামনে ঝুঁকে ট্যাক্সি ড্রাইভারকে রাস্তার পাশে থামতে বলল। ড্রাইভার আপত্তি করে কিছু-একটা বলতে যাচ্ছিল, লুকাসের হাতের লম্বা রিভলবারটি দেখে চুপ করে গেল। সাবধানে ট্যাক্সিটা রাস্তার পাশে দাঁড় করাতেই লুকাস তাকে নেমে যেতে ইঙ্গিত করে। ট্যাক্সি ড্রাইভার আপত্তি না করে ট্যাক্সি থেকে নেমে যেতেই লুকাস ড্রাইভারের সীটে গিয়ে বসে। স্টিয়ারিংয়ে হাত দিয়ে মুহূর্তে সে গতিবেগ তিন শ’ কিলোমিটার করে ফেলল। লুকাস অত্যন্ত দক্ষ ড্রাইভার, রাস্তাঘাটও খুব ভালো চেনে মনে হল, কারণ ট্যাক্সির কম্পিউটারের সাহায্য না নিয়ে এত অবলীলায় সে একটির পর একটি রাস্তা বদল করতে থাকে যে দেখে আমি মুগ্ধ হলাম। ও কোন দিকে যাচ্ছে দেখে আমি খুব অবাক হলাম, শহরের দক্ষিণ প্রান্তে, যেখানে খাড়া পাহাড় প্রায় হাজারখানেক ফিট সোজা নেমে গেছে, সেখানে কোনো মানুষজনের বসতি আছে বলে আমার জানা নেই। আমি লুকাসকে সেটা নিয়ে কিছু-একটা বলতে যাচ্ছিলাম, ঠিক সেই সময়ে আমি আমার সারা শরীরে একটা অসহনীয় যন্ত্রণা অনুভব করলাম, নিয়ন্ত্রণকক্ষ থেকে আমার ট্রাকিওশানে বৈদ্যুতিক তরঙ্গ প্রবেশ করানো হয়েছে।
আমি নিশ্চয়ই আর্তচিৎকার করে উঠেছিলাম, কারণ লুকাস সাথে সাথে গাড়ির গতিবেগ কমিয়ে রাস্তার পাশে দাঁড় করিয়েছে। প্রচণ্ড যন্ত্রণা আমার সমস্ত স্নায়ুমণ্ডলীকে কুরে কুরে খাচ্ছিল, আমি চোখ খুলে রাখতে পারছিলাম না। নিচের চোয়াল শক্ত হয়ে আটকে যায় এবং আমার সমস্ত শরীর ঘামতে থাকে। আমি অনুভব করলাম লুকাস আমার উপর ঝুঁকে পড়ে আমাকে লক্ষ করছে।
যন্ত্রণা যে-রকম হঠাৎ করে শুরু হয়েছিল তেমনি হঠাৎ করে থেমে গেল। সেই মুহূর্তে আমার যে-রকম লেগেছিল সারা জীবনে কখনো সে-রকম আরাম লেগেছে বলে মনে হয় না। লুকাস ফ্যাকাসে মুখে আমার দিকে তাকিয়ে ছিল, আস্তে আস্তে বলল, ট্রাকিওশান ব্যবহার করা শুরু করেছে। আমি খুব দুঃখিত, আমার সাহায্য করার সময় পার হয়ে গেছে।
আমি ব্যাপারটি উড়িয়ে দেয়ার ভঙ্গিতে মাথা নাড়লাম। যন্ত্রণাটা এত ভয়াবহ ছিল যে সেটি আপাতত নেই ভেবেই আমার বুক জুড়িয়ে যাচ্ছে। ভবিষ্যতে কী হবে সেটাও আর তেমন গুরুত্বপূর্ণ মনে হচ্ছে না।
লুকাস বলল, এখন আপনাকে একটু পরে পরে এই যন্ত্রণাটুকু দেয়া হবে। প্রত্যেকবার আগের থেকে বেশি সময় করে, যন্ত্রণার মাত্রাও বেড়ে যাবে ধীরে ধীরে। আপনি যতক্ষণ ওদের কাছে ফিরে না যাচ্ছেন ততক্ষণ এ-রকম চলতে থাকবে।