পুলিস অফিসারটি ট্রিগার টানতে গিয়ে থেমে গেল, চোখের কোনা দিয়ে রবোট দু’টির উপর চোখ রাখতে রাখতে বলল, কি ব্যাপার?
আমি কী ভেবে পকেট থেকে লাল কার্ডটি বের করলাম, সাথে সাথে জাদুমন্ত্রের মতো কাজ হল, পুলিস অফিসারটি অস্ত্রটি নামিয়ে মুখে একটা হাসি ফুটিয়ে মাথা নুইয়ে অভিবাদন করল। আমি লাল কার্ডটি তার হাতে দিলাম, সে সেটি তার কোমরে ঝোলানো কমিউনিকেশান বাক্সে প্রবেশ করিয়ে মূল কম্পিউটার থেকে এই লাল। কার্ডের মালিকের পরিচয় বের করে আনল। বাক্সে আমার চেহারা ফুটে ওঠার পর আমার সাথে চেহারা মিলিয়ে নিয়ে কার্ডটি ফেরত দিয়ে বলল, আপনার জন্যে কী করতে পারি?
আমি রবোট তরুণটির দিকে দেখিয়ে বললাম, আমার এই রবোটটি দরকার।
পুলিস অফিসারটির মাথায় বাজ পড়লেও সে এত অবাক হত কিনা সন্দেহ। খুব তাড়াতাড়ি সে মুখের ভাব স্বাভাবিক করে বলল, আপনার সত্যি দরকার?
হ্যাঁ।
বেশ, আপনার যা ইচ্ছা। তারপর গলা নামিয়ে বলল, আপনি নিশ্চয়ই জানেন এরা অত্যন্ত ভয়ংকর প্রকৃতির?
জানি।
বেশ, বেশ। পুলিস অফিসারটি হাত নেড়ে তরুণটিকে ডাকল। তরুণটি এক পা এগিয়ে এসে আবার মেয়েটির কাছে ফিরে যায়, তাকে সোজা করে শুইয়ে খোলা চোখ দু’টি যত্ন করে বন্ধ করে দিল। কয়েক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে থেকে একটি দীর্ঘশ্বাস গোপন করে লম্বা লম্বা পা ফেলে আমার দিকে এগিয়ে আসে।
পুলিস অফিসারটি কিছু বলার আগেই আমি তার হাত ধরে টেনে বললাম, আমার সাথে চল।
চারদিকে মানুষের ভিড় জমে গিয়েছিল। আমি ভিড় ঠেলে তরুণটিকে নিয়ে অগ্রসর হওয়ার সময় বিস্ময়ের একটা গুঞ্জন জেগে ওঠে। আমি কোনোকিছুকে পরোয়া না করে সোজা একটা ট্যাক্সির দিকে এগিয়ে যাই। ট্রাক্সি ড্রাইভার দরজা খোলার আগেই আমি দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে ড্রাইভারের হাতে লাল কার্ডটি ধরিয়ে দিলাম। ট্যাক্সি ড্রাইভার তার বাক্সে সেটা একবার প্রবেশ করিয়ে অত্যন্ত বিনীতভাবে জিজ্ঞেস করল, কোথায় যাব?
সামনে।
ট্যাক্সি ছুটে চলল, গতিবেগ দেখতে দেখতে আশি নবৃই এক শ’ হয়ে দুই শ’ কিলোমিটারে লাফিয়ে উঠে স্থির হয়ে গেল।
রবোট তরুণর্টি এতক্ষণ একটি কথাও বলে নি, এবারে খুব আস্তে আস্তে, শোনা যায় না এরকম স্বরে বলল, আপনাকে কী জন্যে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছে?
আমি চমকে উঠে তার দিকে তাকালাম, তুমি কেমন করে জানলে?
আপনার লাল কার্ডটি সবসময়েই গো কম্পিউটারে আপনার উপস্থিতি জানিয়ে খবর পাঠাচ্ছে, তা ছাড়াও আমার মনে হচ্ছে আপনার হৃৎপিণ্ডে একটা ট্রাকিওশান আছে, এই মুহূর্তে সেটা চালু করা হল। আপনাকে কর্মকর্তাদের দরকার এবং আপনি পুরোপুরি তাদের হাতের মুঠোয় আছেন। মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামী ছাড়া আর কাউকে এত তীক্ষ্ণ নজরে রাখা হয় না। এ ছাড়াও আপনি যেভাবে আমাকে বাঁচিয়ে এনেছেন সেটি অবৈধ, তার শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। যেহেতু আপনার সে ভয় নেই, আমি ধরে নিচ্ছি আপনাকে ইতোমধ্যে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছে।
আমি মাথা নেড়ে বললাম, যুক্তিতে কোনো ভুল নেই, আমাকে সত্যি মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছে।
রবোট তরুণটি আমার দিকে তাকিয়ে বলল, কেন, জিজ্ঞেস করতে পারি?
ক্রুগো কম্পিউটার থেকে একটা সংবাদ বের করা নিয়ে একটা ব্যাপার হয়েছিল, আমি জিনিসটা ঠিক আলোচনা করতে চাই না। বিশেষ করে তোমার মতো একজন রবোটের সাথে–
ও। তরুণটি একটু আহত হল মনে হল, কথা ঘোরানোর জন্যে বলল, আমাকে বাঁচিয়ে আনার জন্যে ধন্যবাদ। এখন আমাকে নিয়ে আপনার কী পরিকল্পনা?
কিছু না।
আমি পালিয়ে গেলে আপনার কোনো আপত্তি আছে?
না।
চমৎকার! আপনার কোনো ক্ষতি করতে আমার খুব খারাপ লাগত।
আমি একটু অবাক হয়ে তার দিকে তাকালাম, মানে?
একটু আগে যখন আমি আর লানা ধরা পড়েছিলাম, আমরা তখন পালানোর কোনো চেষ্টা করি নি। কারণ তখন আমাদের পালানোর সম্ভাবনা ছিল শতকরা দশমিক শূন্য শূন্য এক থেকে তিনের ভেতর। যখন সম্ভাবনা বেশি থাকে আমরা প্রাণপণ চেষ্টা করি। এখন পালিয়ে যাবার চেষ্টায় সফল হবার সম্ভাবনা শতকরা পঞ্চাশ থেকে বেশি, কাজেই আমি প্রাণপণ চেষ্টা করব। আপনি যদি বাধা দেবার চেষ্টা করতেন, আপনাকে আমার আঘাত করতে হত।
আমি যতদূর জানি, তোমাদের, রবোটদের এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে যে, তোমরা কখনো কোনো মানুষের ক্ষতি করতে পার না।
সেটি আর সত্যি নয়। আমরা পালিয়ে যাবার পর আমাদের কপোট্রনে পরিবর্তন করে নিয়েছি, আমাদের এ ছাড়া বেঁচে থাকা মুশকিল।
ও, আচ্ছা। আমি কিছুক্ষণ তরুণটিকে লক্ষ করে বললাম, তোমার সাথে ঐ মেয়েটি কে ছিল?
আমার বান্ধবী লানা। আমাদের দু’ জনের টিউনিং সার্কিট এক ফ্রিকোয়েন্সিতে রেজোনেট করত।
তার মানে কি?
তার মানে সে আমার খুব আপনজন ছিল।
তোমাদের কি দুঃখবোধ আছে?
তরুণ রবোটটি আমার মুখের দিকে তাকিয়ে কষ্ট করে হেসে বলল, আছে। মানুষের যে-সব অনুভূতি থাকে আমাদের সব আছে। আপনি জানতে চাইছেন না। মারা যাওয়াতে আমি দুঃখ পেয়েছি কিনা। আমি দুঃখ পেয়েছি, আমি যে কী কষ্ট পাচ্ছি। আপনাকে বোঝাতে পারব না। কখনো আপনার কোনো প্রিয়জন মারা গিয়ে থাকলে হয়তো আপনি বুঝতে পারবেন।
আমার এই রবোট তরুণটির জন্যে কষ্ট হতে থাকে। তার হাত স্পর্শ করে বললাম, আমি দুঃখিত–
আমার নাম লুকাস।
আমি দুঃখিত লুকাস, আমি খুবই দুঃখিত।
লুকাস মাথা নিচু করে বসে থাকে, আমি দেখতে পেলাম তার চোখ থেকে ফোঁটা ফোঁটা পানি গাল বেয়ে পড়ছে। মানুষের অপূর্ব অনুকরণ করেছে রবোট্রন নামের এই রবোটেরা!