লুকাস হাতের অস্ত্রটি ছুঁড়ে দিয়ে মাথার উপর গোলাকার ঢাকনাটি খুলে ফেলল। ঘুরে আমার দিকে তাকাল সে, তারপর লম্বা লম্বা পা ফেলে ছুটে এল দ্রুত। সাবধানে আমাকে সোজা করিয়ে বসিয়ে গুলির আঘাতটি পরীক্ষা করে, তারপর শার্ট ছিড়ে ভাঁজ করে আমার ক্ষতস্থানে চেপে ধরে রক্ত বন্ধ করার জন্যে। তার দিকে তাকাতেই সে।
কে জিজ্ঞেস করে, কে গুলি করেছে আপনাকে? আমি?
হ্যাঁ। কী মনে হয়, বেঁচে যাব এযাত্রা?
অন্য কেউ হলে সন্দেহ ছিল, কিন্তু আপনাকে মারবে কে? মৃত্যুদণ্ড মাথায় নিয়ে আপনি রুকুন গ্রহপুঞ্জ ঘুরে এসেছেন—স্বয়ং বিধাতা আপনাকে বাঁচিয়ে রেখেছেন, আমি কি আপনাকে মারতে পারি? নাকি ক্রুগো পারবে?
লুকাস ঝুঁকে পড়ে আমার হাত চেপে ধরে বলল, কিম জুরান, পৃথিবীর মানুষ আর পৃথিবীর সব রবোট্রন যুগ যুগ আপনার কথা মনে রাখবে—কেন জানেন? কারণ—
কারণটা আমার শোনা হল না, লুকাসের হাতে মাথা রেখে আমি জ্ঞান হারালাম।
———–
পরিশিষ্ট
পরবর্তী ঘটনা সংক্ষিপ্ত। ক্রুগো কম্পিউটারকে অচল করে দেবার পরপরই আবার নূতন করে সর্বোচ্চ কাউন্সিল তৈরি করা হয়েছে। আগের সর্বোচ্চ কাউন্সিলের দশ জনকেই নাকি ক্রুগো কম্পিউটার মেরে ফেলেছিল। শাসনতন্ত্রে সাহায্য করার জন্যে নূতন একটা কম্পিউটার তৈরি করা হচ্ছে, কে তৈরি করেছে সেটা গোপন, কিন্তু বিশ্বস্তসূত্রে আমি খবর পেয়েছি লুকাস নাকি সেখানকার কর্তাব্যক্তিদের একজন। (আজকাল উচ্চ মহলে আমার অনেক পরিচিত বন্ধুবান্ধব, অনেক গোপন খবর পাই আমি। রবোট্রনদের আবার মানুষের সাথে পাশাপাশি থাকার সুযোগ দেয়া হয়েছে, তবে এক শর্তে, তারা আর কখনো মানুষের চেহারা নিতে পারবে না, তাদেরকে যন্ত্রের মতো দেখাতে হবে। ভিকির সেটা নিয়ে খুব মন-খারাপ, কিন্তু রবোট্রনদের কারো আপত্তি নেই। প্রাণ বাচানোর জন্যে তারা এটা করেছিল, এখন এটা একটা বাড়তি সমস্যার মতো। যেমন সুয়ের কথা ধরা যাক, সে যে-কলেজে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ায় সেখানকার সব পুরুষ ছাত্র নাকি তার প্রেমে পড়ে গেছে, সে রবোট্রন জেনেও। একজন নাকি আবার সুয়ের জন্যে ঘুমের বড়ি খেয়ে আত্মহত্যা করার চেষ্টা করেছিল, পাগল আর কাকে বলে!
রুকুন গ্ৰহপুঞ্জে আবার নাকি একটা মহাকাশযান পাঠানো হবে, আমার কাছ থেকে সবকিছু শুনে বিজ্ঞানীদের সাহস অনেক বেড়ে গেছে, কয়েকজন বিজ্ঞানী নাকি স্বেচ্ছায় রাজি হয়েছেন যাবার জন্যে। তাঁরা কী—একটা যন্ত্র তৈরি করেছেন, সেখানে নাকি নিউট্রিনো ব্যবহার করে রুকুন গ্ৰহপুঞ্জের সাথে যোগাযোগ করা হবে। মহাকাশযানটি ফিরে আসতে আসতে আরো প্রায় এক বছর, কী হয় দেখার জন্যে আমি খুব কৌতূহল নিয়ে অপেক্ষা করে আছি।
নীষা বাচ্চাদের একটা হাসপাতালে ডাক্তারের একটা ভালো চাকরি পেয়েছে। তার সাথে জীবন, মৃত্যু, ভালবাসা, বেঁচে থাকার সার্থকতা ইত্যাদি বড় বড় জিনিস নিয়ে প্রায়ই আমার সুদীর্ঘ আলাপ হত, ইদানীং ব্যক্তিগত জিনিস নিয়ে কথাবার্তা শুরু করেছি। তার নাকি বিয়ের কোনো পরিকল্পনা ছিল না, আমারও তাই। (আমাদের দু’জনের অনেক বিষয়ে মিল রয়েছে। তবে সারাদিন কাজকর্ম করে সন্ধ্যায় একা শূন্য বাসায় ফিরে আসতে নাকি তার খুব খারাপ লাগে। কথাটা মিথ্যে নয়, তাই অনেক চিন্তা-ভাবনা করে দু’জনেই বিয়ে করব ঠিক করেছি। একজন আরেকজনকে, সেটাই সুবিধে, দু’জনের জন্যেই।
বিয়ের অনুষ্ঠান হবে খুবই অনাড়ম্বর। খুব ঘনিষ্ঠ ক’জন মানুষ আর রবোট্রন ছাড়া অন্য কেউ থাকবে না। শহরতলির অ্যাপার্টমেন্টের সেই বুড়োকে বিয়েতে আমন্ত্রণ জানাতে গিয়েছিলাম। সাথে নীষা ছিল, বুড়ো তাকে চিমটি কেটে পরীক্ষা করে দেখল মানুষ কি না, এখনো তার রবোট্রনকে খুব ভয়। (তার চেক নাকি আবার আসতে শুরু করেছে।)
খুব বেশি যদি খুঁতখুঁতে না হই, তাহলে স্বীকার করতেই হবে যে বেঁচে থাকা ব্যাপারটা মোটামুটি খারাপ নয়।