লুকাস ম্যাপ দেখতে দেখতে হাঁটছিল, ভেতরে কোথায় কোন আই. সি. রয়েছে সেই ম্যাপে দেখানো আছে। একসময় সে থমকে দাঁড়িয়ে বলল, কিম জুরান, আমরা এসে গেছি, আপনি বাম দিক থেকে শুরু করুন, আমি ডান দিক থেকে।
আমি পকেট থেকে স্কু ড্রাইভারটা বের করে সাবধানে আই. সি.গুলো টেনে তুলতে থাকি। ছোট ছোট কালো আই. সি., সাধারণ লজিক গেট দেখতে যেরকম হয়, মোটেও মূল্যবান প্রসেসরের মতো নয়, পিনের সংখ্যা কম, কোনো রেডিয়েটরও নেই। আমার একটু খটকা লাগে, ইতস্তত করে লুকাসকে ডাকলাম, লুকাস।
কি?
আমি লুকাসের দিকে তাকিয়ে ব্যাপারটি জিজ্ঞেস করতে গিয়ে থেমে গেলাম। লুকাসের শিল্ডিংয়ের একটা অংশ নেই, মুহূর্তে পুরো ব্যাপারটি আমার কাছে পরিষ্কার হয়ে গেল। আমার সামনে যে দাঁড়িয়ে আছে সে আর লুকাস নয়, সে এখন ক্রুগো কম্পিউটার! লুকাসের সার্কিট জ্যাম করার বদলে ক্রুগো তাকে দখল করে নিয়েছে, আমাকে ভাঁওতা দিয়ে আবার সেই একইভাবে আমাদের সর্বনাশ করিয়ে নিচ্ছিল।
আমি উঠে দাঁড়াতেই লুকাস হঠাৎ করে তার স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রটি টেনে নেয়। আমার বুক কেঁপে ওঠে, কী করছে সে? শুকননা গলায় জিজ্ঞেস করলাম, কী হয়েছে। তোমার?
লুকাস কোনো কথা না বলে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রটি আমার দিকে তাক করে, আর আমি হঠাৎ করে বুঝতে পারি আমার সময় শেষ। এত চেষ্টা, এত কষ্ট—সবকিছু এখন শেষ হয়ে যাবে, ছোট একটি ভুলের জন্যে। লুকাসকে বাইরে রেখে আমি যদি শুধু একা ভেতরে ঢুকতাম।
মানুষ কখনো আশা ছেড়ে দেয় না, শেষ মুহূর্তে আমিও মরিয়া হয়ে ছুটতে শুরু করি, ভেতরে গুলির প্রচণ্ড কান-ফাটানো আওয়াজ হল, আমার ঘাড়ের কাছে কোথায় জানি তীব্র যন্ত্রণা করে ওঠে, নিশ্চয়ই গুলি লেগেছে। আমি পড়ে যেতে যেতে উঠে দাঁড়াই, এখনো মরি নি, একবার শেষ চেষ্টা করা যায় না?
একটু দূরে দেখা যাচ্ছে দুই হাজার পিনের প্রসেসর, উপরে সোনালি রেডিয়েটর, ঐগুলো নিশ্চয়ই সবচেয়ে প্রয়োজনীয় আই. সি. ওর একটা, তুলতে পারলে নিশ্চয়ই কিছু একটা হবে। আমি টলতে টলতে প্রসেসরগুলোর কাছে এসে দাঁড়াই—যে- কোনো মুহূর্তে একটা গুলি এসে আমাকে ছিন্নভিন্ন করে দেবে আশঙ্কায় আমার সমস্ত স্নায়ু টানটান হয়ে থাকে, কিন্তু কোনো গুলি আমাকে শেষ করে দিল না। আমি মাথা ঘুরিয়ে দেখি লুকাস আমার দিকে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রটি তাক করে এক পা এক পা করে এগিয়ে আসছে। কিন্তু গুলি করছে না। কেন?
হঠাৎ করে আমি বুঝতে পারি কেন সে গুলি করছে না, আমি এখন দাঁড়িয়ে আছি সবচেয়ে জরুরি প্রসেসরগুলোর সামনে, আমাকে গুলি করলে এই প্রসেসরও ধ্বংস হয়ে যাবে, ক্রুগো সেটা করতে চায় না। হঠাৎ আমার শরীরে হাতির মতো বল এসে যায়, আমি পাগলের মতো পেছনের প্রসেসরের উপর ঝাপিয়ে পড়ি, হাতের স্ক্র ড্রাইভারটা দিয়ে আঘাত করতেই ঠুনকো প্রসেসরটি ঝনঝন করে ভেঙে যায়।
লুকাস হঠাৎ হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেল, প্রসেসরটি হারিয়ে নিশ্চয়ই ক্রুগো কম্পিউটার তার নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেছে! আমি পাগলের মতো পাশের প্রসেসরটিকে আঘাত করি, এটা অনেক শক্ত, আমার আঘাতে কিছু হল না। আমি আতঙ্কিত হয়ে দেখি লুকাস আবার উঠে দাঁড়িয়েছে, টলতে টলতে আমার দিকে এগিয়ে এসে আবার তার স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রটি তুলে ধরেছে, আমি প্রাণপণে প্রসেসরটির নিচে স্ক্রু ড্রাইভার ঢুকিয়ে হ্যাচকা টানে সেটিকে তুলে ফেললাম, সাথে সাথে লুকাস আর্তচিৎকার করে হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেল।
আমার হঠাৎ করে ভীষণ দুর্বল লাগতে থাকে, ঘাড়ের কাছে কোথাও গুলি লেগেছে, রক্তে সারা পিঠ আর হাত চটচটে হয়ে গেছে, চেষ্টা করেও চোখ খোলা রাখতে পারছি না। প্রচণ্ড তৃষ্ণায় বুকের ছাতি ফেটে যাচ্ছে। আমি আরো একটা প্রসেসর তোলার চেষ্টা করলাম, কিন্তু হাতে আর জোর নেই, ভ্রু ড্রাইভারটা নিচে ঢোকানোর চেষ্টা করতেই মাথা ঘুরে ওঠে, কোনোমতে দেয়াল ধরে নিজেকে সামলে নিই, আর ঠিক তক্ষুণি তাকিয়ে দেখি লুকাস আবার টলতে টলতে উঠে দাঁড়িয়েছে, তার হাতে এখনো সেই স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র। এক পা এক পা করে সে আমার দিকে এগিয়ে আসে, দু’ হাত সামনে দাঁড়িয়ে সে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রটি তুলে ধরে, আমি তার চোখের দিকে তাকানোর চেষ্টা করলাম, অদ্ভুত পোশাকে মুখ ঢেকে আছে, তার চেহারা দেখা যাচ্ছে না। আমি চোখ বন্ধ করে দাঁড়িয়ে থাকি। পর মুহূর্তে লুকাস ট্রিগার টেনে ধরে। স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রের কানফাটানো কর্কশ শব্দের মাঝে হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেলাম আমি। কয়েক মুহূর্ত লাগল বুঝতে যে আমার গায়ে গুলি লাগে নি। চোখ খুলে তাকালাম আমি, সত্যি তাই, আমার গায়ে একটি গুলিও লাগে নি। কেন লাগবে? লুকাস আমাকে গুলি করে নি, গুলি করেছে আমার পেছনে সারি সারি প্রসেসরগুলোতে।
লুকাস আবার তার অস্ত্র তুলে নেয়, তারপর আবার পাগলের মতো গুলি করতে শুরু করে। প্রচণ্ড শব্দে কানে তালা লেগে যায়, ধোঁয়ায় ভরে যায় চারদিক। কয়েক মিনিট গুলির শব্দ ছাড়া আর কোথাও কিছু নেই। প্রচণ্ড আক্রোশে সবকিছু ছিন্নভিন্ন করে দিচ্ছে লুকাস। কখনো থামবে মনে হচ্ছিল না, কিন্তু গুলি শেষ হয়ে গেল। একসময়। ঠিক তখনই আমি ক্রুগোর আর্তচিৎকার শুনতে পাই। মরণাপন্ন মানুষের কান্নার মতো সেই ভয়াবহ চিৎকার বদ্ধ ঘরের দেয়াল থেকে দেয়ালে প্রতিধ্বনিত হয়ে ধীরে ধীরে মিলিয়ে যায়। আশ্চর্য একটা নীরবতা নেমে আসে হঠাৎ, কবরেও বুঝি কখনো এরকম নীরবতা নামে না।