আমি কী বলতে চাইছি তুমি শুনবে তো আগে।
আমি জানি তুমি কী বলবে।
কী বলব?
তুমিও আমাদের সাথে যেতে চাইবে। কিন্তু তা হয় না নীষা, আমাদের দলের অন্তত একজন মানুষকে যে-কোনো অবস্থায় বেঁচে থাকতে হবে। আমি তোমাদের দু’ জনের জীবন নিয়েই ঝুঁকি নিতে পারি না। তুমি জান আজ সারাদিনে আমাদের উপর ক্রুগো কম্পিউটার যেসব আঘাত হেনেছে, তাতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে মানুষেরা। এখন তোমরা দু জন ছাড়া আমাদের দলে আর কোনো মানুষ নেই।
নীষা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে চুপ করে যায়। লুকাস অন্য সবার দিকে তাকিয়ে বলল, কারো কোনো প্রশ্ন আছে?
সু হাত তুলে বলল, আমরা যদি ব্যর্থ হই?
লুকাসের চোখ একবার ধক করে জ্বলে উঠল, সুয়ের দিকে তীব্র দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, আমরা ব্যর্থ হব না।
শহরতলিতে জুগো কম্পিউটারের যে বড় ভবনটি আছে, আমি লুকাসের দলের পনের জনের সাথে সেখানে অপেক্ষা করছি। ছোট ছোট গাড়িতে ভিন্ন ভিন্ন দলে সবাই এসে একত্র হয়েছে। গাড়িগুলো ছোট হলেও বিস্ময়কর। এগুলো স্বয়ংক্রিয় এবং পুরোটা শক্তিশালী ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে বোঝাই। আপাতত সেগুলো নিরীহভাবে চারপাশে ছড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
জুগোর ভবনটি অত্যন্ত সুরক্ষিত। উচু চওড়া দেয়াল, কাঁটাতারের বেষ্টনি, উচ্চচাপের বৈদ্যুতিক তার, সশস্ত্র প্রহরা সবকিছুই এখানে রয়েছে। এই ভবনে ঢোকার জন্য লুকাসের পরিকল্পনা খুব সহজ। একই সাথে ভবনটিকে চারদিক থেকে আক্রমণ করা হবে, ঠিক কোন পথে শত্রুরা আসবে বুঝতে দেয়া হবে না। তাদের বিভ্রান্ত করার জন্যে দ্বিতীয় পর্যায়ে মূল গেট দিয়ে দু’টি গাড়ি স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র নিয়ে ভেতরে ঢুকে যাবে। গাড়ি দু’টিকে বাইরে থেকে নিয়ন্ত্রণ করে সমস্ত লক্ষ্যস্থলের কেন্দ্র হিসেবে ও করানো হবে। ঠিক এই সময় আক্রমণের তৃতীয় পর্যায় শুরু হবে। লুকাস তার দলবল নিয়ে দক্ষিণ দিকের দেয়াল উড়িয়ে দিয়ে ভেতরে ঢুকে যাবে। ভেতরে খণ্ডযুদ্ধ হবে। যারা বেঁচে থাকবে তারা মূল ইলেকট্রনিক্স ভবনের সামনে এসে হাজির হবে। আমি থাকব সাথে, যখন ইলেন মূল ভবনের দরজা খুলে দেবে, ভেতরে ঢুকে যাব। তার পরের কাজ সহজ, বেছে বেছে প্রয়োজনীয় আই. সি.গুলো তুলে নেয়া, আমি আগেও একবার করেছি।
নির্দিষ্ট সময়ে আমরা পরিকল্পনামাফিক দূরে প্রচণ্ড বিস্ফোরণ, সাথে সাথে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রের শব্দ শুনতে পেলাম। কয়েক মুহূর্ত পরেই আমাদের নিরীহ গাড়িগুলো তাদের ক্ষেপণাস্ত্র থেকে গোলা ছুড়তে থাকে। ভবনটির নানা অংশ আমি বিস্ফোরণে উড়ে যেতে দেখলাম। লুকাস আর তার দলবল শান্তভাবে অপেক্ষা করতে থাকে, আমার পক্ষে সেটা সম্ভব নয়, নিজেকে মাটির সাথে মিশিয়ে আমি শুয়ে থাকি, প্রত্যেকটা বিস্ফোরণের শব্দে আমি চমকে উঠছিলাম, মনে হচ্ছিল আমার কানের পর্দা যে-কোনো মুহূর্তে ফেটে যাবে। আমি দরদর করে ঘামছিলাম এবং প্রচণ্ড তৃষ্ণায় আমার বুকের ছাতি ফেটে যাচ্ছিল।
একসময় লুকাস হাত দিয়ে ইঙ্গিত করতেই দু’টি গাড়ি কোনো চালক ছাড়াই হঠাৎ বাইরের গেট দিয়ে ভবনের ভেতরে ঢুকে পড়ার চেষ্টা করে। প্রচণ্ড গোলাগুলি হতে থাকে, আমি লেজারের তীব্র আলো ঝলসে উঠতে দেখি। গাড়ি দু’টি থেকে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র বৃষ্টির মতো গোলাগুলি করতে থাকে, ক্রুগোর ভবনের প্রহরীরা গাড়ি দু’টিকে ঘিরে একটা ব্যুহ তৈরি করার জন্যে মরিয়া হয়ে ওঠে।
সবকিছু পরিকল্পনামাফিক কাজ করছে, লুকাস চারদিকে ঘুরে একবার তাকিয়ে হাত দিয়ে ইঙ্গিত করতেই পুরো দলটা উঠে দাঁড়ায়। আমার একা একা অপেক্ষা করার কথা, উঠে দৌড় দেবার প্রবল ইচ্ছাটাকে অনেক কষ্টে দমন করে আমি কান চেপে মাটিতে শুয়ে থাকি। একটু পরেই প্রচণ্ড বিস্ফোরণের শব্দ শুনতে পেলাম। খানিকক্ষণের জন্যে একটা আশ্চর্য নীরবতা নেমে আসে, তারপর হঠাৎ আবার গোলাগুলি শুরু হয়ে যায়। কতক্ষণ শুয়ে ছিলাম জানি না, আমার তখন সময়ের কোনো জ্ঞান নেই, মনে হচ্ছিল কয়েক যুগ পার হয়ে গেছে। এই সময়ে হঠাৎ দেখতে পাই সু গুড়ি মেরে এগিয়ে আসছে।
কাছে এসে চিৎকার করে বলল, কিম জুরান, চলুন যাই।
সবকিছু ঠিকমত চলছে?
মোটামুটি। দু জন মারা গেছে আমাদের।
অন্ধকারে বিস্ফোরণের আলোতে পথ দেখতে দেখতে সুয়ের হাত ধরে আমি এগোতে থাকি। আমাদের দু’পাশ দিয়ে গুলি বেরিয়ে যাচ্ছিল, এর কর্কশ শব্দে কানে তালা ধরে যাবার অবস্থা। সু গলা উচিয়ে বলল, ভয় পাবেন না, লুকাস আমাদের কভার করছে।
যদিও ভয়ে আমার হৃৎস্পন্দন থেমে যাবার অবস্থা, আমি সেটা স্বীকার করলাম না, চিৎকার করে বললাম, ভয়ের কী আছে, আমরা তো এসেই গেছি।
সত্যি সত্যি আমরা প্রায় পৌছে গেছি, সামনের দেয়ালে বড় ফুটো, ইতস্তত বৈদ্যুতিক তার ঝুলছে। আমার শরীরে বিশেষ বিদ্যুৎ অপরিবাহী পোশাক, কাজেই আমি ইতস্তত না করে ভেতরে ঢুকে গেলাম। ভেতরে আবছা অন্ধকার, ধুলোবালি উড়ছে। লুকাসের গলার স্বর শোনা গেল, কিম জুরান, ঠিক আছে সবকিছু?
হ্যাঁ।
চলুন যাই।
কে-একজন বলল, প্রহরীদের একটা দল আসছে সামনে দিয়ে। লুকাস কোমর থেকে খুলে কী-একটা ছুঁড়ে দেয়, প্রচণ্ড বিস্ফোরণে চারদিক অন্ধকার হয়ে যায় সাথে সাথে।
আমার সাথে আসুন কিম জুরান। লুকাস আমার হাত ধরে টানতে টানতে বলে, ঐ যে সামনে গোর মূল ভবন, সি. পি. ইউ. ওখানেই আছে।
ধুলোবালির মাঝে কাশতে কাশতে আমি এগোচ্ছিলাম, হঠাৎ পুরো এলাকাটি তীব্র আলোতে ভরে গেল। তীক্ষ্ণ একটা কণ্ঠস্বর চিৎকার করে বলল, যে যেখানে আছ দু হাত তুলে দাঁড়াও, তোমাদের দিকে আমরা আগ্নেয়াস্ত্র তাক করে আছি।