সবশেষে আমার শরীরে ক্ষুদ্র একটি ট্রাকিওশান প্রবেশ করিয়ে দেয়া হল।
০২. লুকাস নামের রবোট
২. লুকাস নামের রবোট
আমি উদ্দেশাহীনভাবে শহরের সবচেয়ে সম্রান্ত অঞ্চলের মাঝে হাঁটছিলাম। দেশের প্রথম শ্রেণীর নাগরিকদের অঞ্চল এটি, বিজ্ঞানী, ইঞ্জিনিয়ার বা উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মচারী ছাড়া আর কেউ আসতে পারে না। আমার পক্ষে কখানোই এখানে আসা সম্ভব হত না, কিন্তু আমাকে স্বাধীনভাবে ঘুরতে দেয়ার সময় কর্মকর্তারা আমাকে একটা ছোট লাল কার্ড দিয়েছে, এই কার্ডটির ক্ষমতার কোনো সীমা নেই। অত্যন্ত বড় বিজ্ঞানী বা অত্যন্ত উচ্চপদস্থ সরকারি কর্তকর্তা ছাড়া আর কেউ এই লাল কার্ড ব্যবহার করতে পারে না, আমাকে সম্ভবত করুণা করে দেয়া হয়েছে। এটি ব্যবহার করে যে-কোনো যানবাহনে যে-কোনো অঞ্চলে যাওয়া যায়, যে-কোনো হোটেলরেস্টুরেন্ট বা অবসর বিনোদনের সুযোগ নেয়া যায়, এমন কি সরকারি নিয়ন্ত্রণে চালিত গোপন প্রতিষ্ঠানগুলোতে পর্যন্ত প্রবেশাধিকার পাওয়া যায়। এই কার্ডটির ক্ষমতা পরীক্ষা করার জন্যে আমি অতিপারমাণবিক অস্ত্র কারখানা থেকে ঘুরে এসেছি।
আজ আমার জীবনের শেষ সপ্তাহের শেষ দিনটি। আগামীকাল দুপুরে আমার মহাকাশ কেন্দ্রে ফিরে যাবার কথা। সন্ধ্যাবেলা মহাকাশযানটি আমাকে নিয়ে আমার অন্তিম যাত্রা শুরু করবে। কথাটি ভুলে থাকার চেষ্টা করে লাভ নেই, এটি বিকারগ্রস্ত মানুষের স্বপ্নের মতো আমার মাথায় জেগে আছে।
আমি একটা সম্রান্ত বিপণিকেন্দ্রের পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় খানিকটা উত্তেজনা লক্ষ করলাম। বেশ কয়েকটা পুলিসের গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে, রাস্তার মোড়ে মোড়ে ইতস্তত সশস্ত্র পুলিস, হাতে রনোগান। দেখে মনে হল বেশ খানিকটা এলাকা তারা ঘিরে রেখেছে, নিশ্চয়ই কয়েকটা রবোট্রন ধরা পড়েছে। রবোট্রন রবোটের সবচেয়ে শক্তিশালী আর উন্নত গোত্রটি। পাঁচ বছর আগে তাদের ধ্বংস করার আইন পাস করা হয়েছে, রবোট্রন গোষ্ঠী যদিও মানুষের তৈরি, তারা মানুষের এই আইন মেনে নিতে রাজি হয় নি। বিরাটসংখ্যক রবোট্রন লোকালয় থেকে পালিয়ে যায়, সেই থেকে তাদের খুঁজে খুঁজে বের করে হত্যা করা হচ্ছে। রবোট্রন জীবিত প্রাণী নয়, একটি যন্ত্রবিশেষ, তাই হত্যা শব্দটি তাদের জন্যে প্রযোজ্য নয়, কিন্তু আত্মগোপন করার জন্যে তারা মানুষের এত চমৎকার রূপ নিয়েছে যে অঙ্গব্যবচ্ছেদ না করে আজকাল আর বলা সম্ভব নয় কোনটি মানুষ, আর কোনটি রবোট্রন। আমি জাদুঘরে বিকল রবোট্রন। দেখেছি, সত্যিকারের রবোট্রন কখনো দেখিনি, তাই খানিকটা কৌতূহল নিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লাম।
বিপণিকেন্দ্রটি থেকে লোকজন বের হয়ে আসছিল, আমি আন্দাজ করার চেষ্টা করছিলাম তাদের মাঝে কে রবোট হতে পারে। নানা বয়সের, নানা আকারের, নারী পুরুষ-শিশু কাউকে রবোট মনে হয় না। এমন সময় দু’ জন তরুণ-তরুণীকে তাড়াহুড়া করে বের হতে দেখা গেল, দেখে ভুলেও রবোট বলে সন্দেহ হয় না। দরজায় দাঁড়ানো পুলিস অফিসারটি তাদের থামিয়ে কী—সব প্রশ্ন জিজ্ঞেস করল। একই পরেই পুলিস অফিসারটি তাদের কী-একটা আদেশ দিল এবং দু’ জন বাধ্য শিশুর মতো দেয়ালের পাশে গিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। পুলিস অফিসারটি গলায় লাগানো চৌকোনা বাক্সে কার সাথে জানি খানিকক্ষণ কথা বলে মেগাফোনটা টেনে নিয়ে উচ্চস্বরে ঘোষণা করল, এই দু’টি রবোটের এক শ’ ফুটের ভেতরে কেউ থাকবেন না, এখন এই দুটিকে ধ্বংস করা হবে।
আমি অবাক হয়ে এই দু’ জন তরুণ-তরুণীর দিকে তাকিয়ে রইলাম, এরা তাহলে রবোট। কী মিষ্টি চেহারার মেয়েটি আর মুখে কী গাঢ় বিষাদের ছায়া! ছেলেটি মেয়েটির মুখের দিকে খানিকক্ষণ তাকিয়ে থেকে কী যেন বলল, শুনে মেয়েটি মাথা নিচু করে রইল কিছুক্ষণ, যখন মাথা তুলল তখন চোখে পানি টলটল করছে। ছেলেটি এবারে মেয়েটিকে আলিঙ্গন করে তারপর ছেড়ে দেয়। দু’ জন মাথা নিচু করে আবার দেয়ালের পাশে এসে দাঁড়ায়, মাথা নেড়ে বলে, তারা প্রস্তুত। পুলিস অফিসারটি হাতের বিশাল অস্ত্রটি তুলে ধরে মিটার ঘুরিয়ে কী যেন ঠিক করে নেয়, তারপর সোজাসুজি মেয়েটির বুকে গুলি করল। আমি শিউরে উঠে সামনের রেলি ওটা খামচে ধরি, এক ঝলক রক্ত বেরিয়ে আসবে এ ধরনের একটা অনুভূতি হচ্ছিল, কিন্তু সেরকম কিছু হল না। বুকের মাঝে প্রায় চার ইঞ্চি ব্যাসের একটা ফুটো হয়ে গেল, ভেতর থেকে বারকয়েক বৈদ্যুতিক স্ফুলিঙ্গ, সাথে সাথে কিছু কালো ধোঁয়া বের হয়ে আসে। মেয়েটি কাঁপতে কাঁপতে অনেক কষ্টে দেয়াল ধরে দাঁড়িয়ে থাকার চেষ্টা করতে করতে একসময় হাঁটু ভেঙে পড়ে যায়। ছেলেটি ঠোঁট কামড়ে একদৃষ্টে পুলিস অফিসারটির দিকে তাকিয়ে রইল। হাতের অতিকায় অস্ত্রটি এখন তার দিকে উচু করে ধরা হয়েছে।
একটি রবোট ধ্বংস করা আর একটি বাইসাইকেল ধ্বংস করার মাঝে কোনো গুণগত পার্থক্য নেই। কাজেই একটা সাইকেল ধ্বংস করার দৃশ্যে যেটুকু কষ্ট হওয়া উচিত, একটি রবোট ধ্বংস হওয়ার দৃশ্যে তার থেকে বেশি কষ্ট হওয়া উচিত না। কিন্তু মেয়েটির যন্ত্রণাকাতর মুখ এবং ছেলেটির ভাবলেশহীন ভঙ্গিতে ঠোঁট কামড়ে থাকার দৃশ্যে আমি একটি কঠিন আঘাত পেলাম। কী করছি বোঝার আগেই আমি আবিষ্কার করলাম, আমি ছুটে পুলিস অফিসারের হাত চেপে ধরেছি।
এক ঝটকায় নিজের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে পুলিস অফিসারটি অবাক হয়ে আমার দিকে তাকাল। আমি বললাম, দাঁড়ান এক সেকেণ্ড!