আমি কী-একটা বলতে যাচ্ছিলাম, এমন সময় দরজায় আবার শব্দ হল।
মুহূর্তে ঘরে নীরবতা নেমে আসে, চোখের পলকে সবার হাতে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র বের হয়ে আসে। কিশোরী মেয়েটি বিদ্যুৎগতিতে জানালার পাশে এগিয়ে যায়, নাইলনের দড়ি ঝুলিয়ে দেয় জানালা থেকে।
দরজায় আবার শব্দ হল, দ্বিধান্বিত শব্দ।
ইলেন আমাকে ইঙ্গিত করে দরজা খুলে দিতে। আমি দরজা ফাঁক করে উঁকি দিলাম, নেশাসক্ত বৃদ্ধটি উদ্বিগ্ন মুখে দাঁড়িয়ে আছে। আমি দরজা খুলতেই সে বিড়বিড় করে বলল, পুলিস এসেছে।
পুলিস?
হ্যাঁ, একটা একটা করে রুম সার্চ করছে।
সত্যি?
হ্যাঁ, অনেক পুলিস, অনেক বড় বড় অস্ত্র। ভাবলাম তোমাকে বলে দিই। কথা বলতে বলতে সে ঘরে উঁকি দিয়ে সবাইকে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র হাতে দেখে একেবারে ফ্যাকাসে হয়ে যায়। শুকনো গলায় বলল,সর্বনাশ! এরা কারা? রবোট নাকি?
আমি কিছু বলার আগেই সে পিছিয়ে যায়, তারপর প্রাণপণে দৌড়াতে থাকে। রবোটকে তার ভারি ভয়।
আমি ঘরে এসে কিছু বলার আগেই সবাই বের হয়ে এল, তারা আমাদের কথাবার্তা শুনেছে। সময় বেশি নেই, সেটা বুঝতে কারো বাকি নেই। ইলেন চাপা গলায় বলল, লিফট দিয়ে নেমে যাও। দোতলায় থামবে, সেখান থেকে লাফিয়ে বের হতে হবে। পুলিসকে দেখামাত্র আক্রমণ করবে, তারা সম্ভবত আমাদের আক্রমণের জন্যে প্রস্তুত নেই।
ইলেন ঘুরে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, আমাদের আশ্রয় দেয়ার জন্যে ধন্যবাদ। বিদায়।
আমি বললাম, আমি আপনাদের সাথে যাব।
তার প্রয়োজন নেই, পুলিস কখনো জানবে না আমরা আপনার এখানে আশ্রয় নিয়েছিলাম।
সে জন্যে নয়। কী জন্যে? আপনি নিশ্চয়ই জানেন মানুষের নিরাপত্তা আমরা দিতে পারি না।
আমি হচ্ছি সেই মানুষটি, যার ক্রুগো কম্পিউটারের গোপন সংকেত বের করে দেয়ার কথা ছিল।
ওরা চমকে আমার দিকে তাকায়।
আমি গলার স্বর শান্ত রাখার চেষ্টা করে বললাম, আমি আগে রাজি হই নি, কারণ আমি সবকিছু জানতাম না। এখন জেনেছি, তাই মত পাল্টেছি। আপনারা রাজি থাকলে আমি আপনাদের সাহায্য করতে রাজি আছি।
সু নামের কিশোরী মেয়েটি ছুটে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে। ইলেন তার ভাঙা হাত দিয়ে সুকে স্পর্শ করে বলল, সু, এখন ঠিক সময় নয়। কিম জুরানকে ছেড়ে দাও, আমাদের সাথে যেতে হলে তাঁর হয়তো কোনো ধরনের প্রস্তুতি দরকার।
আমি প্রস্তুত আছি,সময় নষ্ট করে লাভ নেই।
ইলেন মাথা ঝুঁকিয়ে বলল, আপনাকে যে কী বলে কৃতজ্ঞতা জানাব বুঝতে পারছি না।
আমি বললাম, তার প্রয়োজন হবে না। আমিও একাধিক ব্যাপারে আপনাদের কাছে ঋণী আছি, ঠিক কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে পারি নি।
ইলেন বলল, চল, রওনা দিই। তোমরা নিশ্চয়ই জান, যে-কোনো মূল্যে কিম জুরানকে রক্ষা করতে হবে।
ছোট দলটি দ্রুতপায়ে এগোতে থাকে, তখন আমি দেখতে পাই বৃদ্ধ লোকটি করিডোরের শেষ মাথায় অতঙ্কিত মুখে দাঁড়িয়ে আছে। কৌতূহলের জন্যে সে ঠিক চলে যেতে পারছে না, আমাকে দেখে সে দ্রুতপায়ে আমার দিকে দৌড়ে আসে, ফিসফিস করে বলে, তোমরা কি লিফট দিয়ে নামবে?
হ্যাঁ।
আরো একটা গোপন পথ আছে, ইলেকট্রিক লাইন নেয়ার একটা টানেল, সেদিক দিয়ে নেমে যাও। সেখানে সিড়ি নেই, কিন্তু রবোটের কি সিঁড়ি লাগে?
আমি ইলেনকে বুড়োর গোপন পথের কথা বলতেই তার মুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। ছুটে এসে জিজ্ঞেস করল, কোথায়?
বুড়ো আমাদের নিয়ে যায়। লিফটের পাশেই একটা বন্ধ দরজা। একজন লাথি দিতেই সেটা খুলে গেল। নানা আকারের অসংখ্য ইলেকট্রিক তার সেদিক দিয়ে নেমে গেছে।
চমৎকার। দেরি নয়, নেমে যাও। কেউ-একজন আমাকে ধর, ইলেন চাপাস্বরে বলল, হাত না থাকায় একেবারে অকেজো হয়ে গেছি। কিম জুরানকে কে নিয়ে যাবে?
সু হাসিমুখে এগিয়ে আসে, আমি, আসুন কিম জুরান।
বুড়োটি আমার কনুই খামচে ধরে, ফিসফিস করে বলল, এরা সবাই রবোট?
হাঁ।
এই মেয়েটিও?
হ্যাঁ।
একটু ছুঁয়ে দেখি? দেখব গো মেয়ে?
সু খিলখিল করে হেসে উঠে হাত বাড়িয়ে দেয়, দেখ বুড়ো।
বুড়োটি ভয়ে ভয়ে তাকে একবার স্পর্শ করে। কনুইয়ে হাত বুলিয়ে সে একটা চিমটি কেটে বলল,ব্যথা পাও?
সু হাসি আটকে বলল, নাহ! ব্যথা পাব কেন?
আশ্চর্য! বুড়ো চোখ কপালে তুলে বলল, মোটেও ব্যথা পায় না। হঠাৎ সে গলা নামিয়ে ফেলল, তাড়াতাড়ি চলে যাও তোমরা। দেরি না হয়ে যায় আবার!
আমি পকেটে হাত ঢুকিয়ে কিছু মুদ্রা বের করে এনে তার হতে গুজে দিয়ে বললাম, বেশি নেই এখানে।
বুড়ো হলুদ দাঁত বের করে হেসে বলে, আমি এখানেই থাকি। পরে এসে দিয়ে যেও। যত ইচ্ছা!
১০. আঘাত
১০. আঘাত
আমি একটা ছোট টার্মিনালের সামনে বসে আছি। আমার ডান পাশে বসেছে লুকাস, পেছনে দাঁড়িয়ে আছে নীষা। আমাকে ঘিরে আরো কয়েকজন রবোট্রন দাঁড়িয়ে, নানা আকারের, নানা বয়সের। বয়সটা যদিও বাইরের ব্যাপার, কিন্তু অনেক যত্নে এদের বয়সের তারতম্য দেখানো হয়। এই টার্মিনালটি ক্রুগো কম্পিউটারের সাথে জুড়ে দেয়া হয়েছে। এটি কোনো অসাধারণ ব্যাপার নয়, সব মিলিয়ে লক্ষাধিক টার্মিনাল সরাসরি ক্রুগো কম্পিউটারের সাথে সংবাদ আদান-প্রদান করে।
আমি টার্মিনালে লিখলাম, ক্রুগো কম্পিউটার, তোমার গোপন সংকেতের প্রথম সংখ্যাটি হচ্ছে শূন্য।
ক্রুগো কম্পিউটার উত্তর দিল, আমার গোপন সংকেত জানার অধিকার আপনার নেই।
আমি লুকাসকে জিজ্ঞেস করলাম, কতক্ষণ সময় লাগল উত্তর দিতে?
তেরো পিকো সেকেন্ড।