ও। দেখতে অসুবিধে হচ্ছে কি?
না। হঠাৎ করে আলো এসে পড়লে একটু অস্বস্তি হয়।
ঠিক হয়ে যাবে। নীষা আবার দীর্ঘ সময়ের জন্যে চুপ করে যায়।
গন্তব্যস্থানে পৌঁছানোর আগে নীষা আবার কথা বলে, আপনার মস্তিষ্ক স্ক্যানিংএর ডিস্কটা দেখছিলাম, আপনার মা খুব সুন্দরী মহিলা।
আমি ঠিক বুঝতে না পেরে বললাম, কিসের ডিস্ক?
আপনার মস্তিষ্ক স্ক্যানিং করার সময় আপনার স্মৃতি একটা ম্যাগনেটিক ডিস্কে জমা রাখা হয়েছিল। সেটাকে বিশেষ পদ্ধতিতে দেখা যায়। আমি খানিকটা দেখেছি, একটা দৃশ্যে ছিল আপনাকে আপনার মা ঘুম পাড়ানোর জন্যে গান গাইছেন, বাইরে বৃষ্টি পড়ছে। খুব মধুর একটা দৃশ্য। আপনার মা খুব সুন্দরী মহিলা।
আমি খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বললাম, আমার মা খুব শৈশবে মারা গেছেন, তাকে নিয়ে নিশ্চয়ই আমার স্মৃতি খুব বেশি ছিল না। যেটুকু ছিল; স্ক্যানিং করে সরিয়ে নেয়া হয়েছে। এখন আমার আর মায়ের কথা মনে নেই।
নীষা আস্তে আস্তে বলল, আমি খুব দুঃখিত কিম জুরান। অনেক চেষ্টা করেও আমি আপনার শৈশবের স্মৃতিটুকু রক্ষা করতে পারি নি।
তোমার দুঃখিত হবার কিছু নেই।
নীয়া অন্যমনস্ক স্বরে বলল, একজনের জীবনের সবচেয়ে মুধুর স্মৃতি তার শৈশবের, সেটা যদি হারিয়ে যায় তাহলে থাকল কী?
আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। নীম্ন তাহলে সত্যিই মানুষ। রবোট্রনের কোনো শৈশব নেই, কোনো বার্ধক্য নেই। শুধু মানুষের শৈশব আছে, শুধু মানুষ জানে শৈশবের স্মৃতি খুব মধুর স্মৃতি। নীষা রবোট্রন হলে কখনো জানত না শৈশবের স্মৃতি হারিয়ে গেলে সেটা খুব কষ্টের একটা ব্যাপার।
আমি কিছু-একটা বলতে যাচ্ছিলাম, ঠিক এই সময় গাড়ির ভেতরে বিবি করে একটা শব্দ হল। নীষা সুইচ টিপে কী-একটা চালু করে দিতেই লুকাসের গলা শুনতে পেলাম। লুকাস বলল, নীষা, একটা ঝামেলা হয়েছে।
কি ঝামেলা? কত বড় ঝামেলা?
অনেক বড়। চার মাত্রার।
নীষা নিঃশ্বাস বন্ধ করে বলল, চার মাত্রা?
হ্যাঁ, সাবধান। তুমি সাত নম্বরে যোগাযোগ কর। নয় নম্বরে এসো না।
আচ্ছা।
আর শোন, আট নম্বর শেষ।
নীষার মুখ রক্তশূন্য হয়ে যায়, শেষ?
হ্যাঁ।
সবাই?
হ্যাঁ। রাখলাম নীষা।
নীষা পাথরের মতো মুখ করে সুইচ টিপে ফোনটা বন্ধ করে দিল। আমি আস্তে আস্তে জিজ্ঞেস করলাম, তোমাকে খুব বিচলিত দেখাচ্ছে নীষা?
নীষা কষ্ট করে একটু হাসে, আমরা ধরা পড়ে গেছি কিম জুরান। আমাদের এখন অনেক বড় বিপদ।
আমার ইচ্ছে হল নীষার মাথায় হাত বুলিয়ে বলি, তোমার কোনো ভয় নেই নীষা, আমি তোমাকে রক্ষা করব। আমি জানি তুমি আমার মতো মানুষ, আমার মতো তোমার দুঃখ-কষ্ট আছে, ভয়-ভীতি আছে, আমি তোমাকে সবকিছু থেকে রক্ষা করব কিন্তু আমি কিছু বলতে পারলাম না।
গাড়িটি একটা বড় বিল্ডিংয়ের সামনে এসে দাঁড়ায়। নীষা আমার হাতে একটা চাবি দিয়ে বলল, আপনার অ্যাপার্টমেন্ট তেত্রিশ তলায়, রুম নাম্বার সাত শ’ এগার। আমি ভেবেছিলাম আপনাকে পৌছে দেব, প্রথম দিন একা একা অচেনা জায়গায় যেতে খুব খারাপ লাগে। কিন্তু এখন আর পারব না। আমাকে এক্ষুণি যেতে হবে।
আমি গাড়ি থেকে নামতে নামতে জিজ্ঞেস করলাম, আমি তোমাকে কোনোভাবে সাহায্য করতে পারি?
আমাকে?
একটু অপ্রস্তুত হয়ে বললাম, তোমাদেরকে?
নীষা ম্লান মুখে বলল, আমি ঠিক জানি না আপনি কোন ধরনের সাহায্যের কথা বলছেন, কিন্তু সম্ভবত আপনার সাহায্য করার সময় পার হয়ে গেছে।
তবু যদি আমার কিছু করার থাকে, আমাকে জানিও।
জানাব।
আমার দিকে হাত নেড়ে নীষা গাড়ি ঘুরিয়ে নেয়, তারপর চোখের পলকে সামনের রাস্তায় অদৃশ্য হয়ে যায়। আমি বিষণ্ণ মুখে দাঁড়িয়ে থাকি, অকারণে আমার মন-খারাপ হয়ে যায়।
০৯. রাতের অতিথি
৯. রাতের অতিথি
বিল্ডিংয়ের দরজায় একটা বুড়ো মতন মানুষ পা ছড়িয়ে বসে আছে, তার দৃষ্টি দেখলেই বোঝা যায় সে নেশাসক্ত। ঢুলুঢুলু চোখে সে আমাকে চলে যেতে দেখল, আমি লিফটের সামনে গিয়ে ঘুরে তাকিয়ে দেখি সে তখনো আমার দিকে তাকিয়ে আছে। লিফটের সুইচে হাত দিতেই সে আমাকে হাত নেড়ে ডাকল, এই যে ভদ্রলোক, এই যে—
আমি তার দিকে এগিয়ে এলাম, কি হয়েছে?
তুমি আজকের খবরের কাগজ দেখেছ?
আমার বুক ধক করে ওঠে, কী বলতে চায় এই বুড়ো? মুখের চেহারা স্বাভাবিক রেখে বললাম, কেন, কী আছে খবরের কাগজে?
বুড়োটি গলা নামিয়ে বলল, তোমার ছবি ছাপা হয়েছে। তুমি নাকি পালাতে গিয়ে পুড়ে মারা গেছ! হলুদ দাঁত বের করে সে খিকখিক করে হাসে, ভালো ঘোল খাইয়েছ তুমি ব্যাটাদের! হা হা হা।
আমি অনেক কষ্ট করে নিজেকে শান্ত রাখলাম, কী সর্বনাশা ব্যাপার!
বুড়োটি ষড়যন্ত্রীদের মতো গলা নামিয়ে বলল, কাদের সাথে কাজ কর তুমি? কোকেনের দল? নাকি ভিচুরিয়াসের? আছে নাকি তোমার সাথে? দেবে একটু আমাকে?
আমি কী করব বুঝতে না পেরে চলে যাবার উদ্যোগ করতেই বুড়োটি খপ করে আমার হাত ধরে ফেলল, বলল, তুমি নিশ্চয়ই রবোটের দলের সাথে আছ, দেখে তো সেরকমই মনে হয় তুমি নিজে রবোট না তো আবার, খুব ভয় আমার রবোটকে!
আমি বুড়োর হাত থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বললাম, ঝামেলা করো না বুড়ো, আমাকে যেতে হবে।
কত দেবে আমাকে বল, নাহয় পুলিসকে খবর দিয়ে দেব, হা হা হা। ময়লা দাঁত বের করে বুড়োটি আবার হাসা শুরু করে।
পুলিসকে এখনো খবর দাও নি তুমি?
না।
আমি পকেট থেকে একটা ছোট মুদ্রা বের করে বুড়োটির দিকে ছুঁড়ে দিয়ে বলি, ঐ যে টেলিফোন আছে, যাও, পুলিসকে ফোন করে দাও।