আমাকে কী করা হবে?
আপনাকে স্বাধীনভাবে বেঁচে থাকার ব্যবস্থা করে দেয়া হবে।
কিন্তু আমাকে কি এখন খোঁজাখুজি করা হচ্ছে না? আমি মৃত্যুদণ্ড পাওয়া আসামী, সবার নাকের ডগা দিয়ে পালিয়ে গেছি, আমার কি স্বাধীনভাবে বেঁচে থাকার উপায় আছে?
লুকাস পকেট থেকে ভাঁজ করা একটা খবরের কাগজ বের করে বলল, আপনাকে আর কখনো কেউ খোজ করবে না। এই দেখেন।
আমি কাগজের উপরে ঝুঁকে পড়ি। মাঝের পাতায় আমার ছবি ছাপা হয়েছে। নিচে লেখা, মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামীর শোচনীয় মৃত্যু। খবরে লেখা যে, মস্তিষ্ক স্ক্যানিং করার পর আমি নিজের মস্তিষ্কের উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে হাসপাতাল থেকে পালানোর চেষ্টা করার পর গুলিবিদ্ধ হই। সেই অবস্থায় একটা গাড়ি থামিয়ে সেখানে ওঠার চেষ্টা করতে গিয়ে গাড়িকে দুর্ঘটনার মুখে ফেলে দিই। ফলে গাড়ির চালক আর আমি দু’ জনেই অগ্নিদগ্ধ হয়ে মারা গেছি। গাড়ির চালককে শনাক্ত করা যায় নি, কিন্তু আমার চুল এবং পোশাকের কিছু অংশ থেকে নিশ্চিতভাবে শনাক্ত করা গেছে।
খবরটি পড়ে আমি অবাক হয়ে লুকাসের মুখের দিকে তাকালাম, এটা কীভাবে সম্ভব?
লুকাস কাগজটি ভাঁজ করে পকেটে রাখতে রাখতে বলল, সবই সম্ভব, ঠিক করে পরিকল্পনা করতে হয়। আমাদের একটা গাড়ি নষ্ট হয়েছে, কিন্তু গাড়ির অভাব কী? তাই বলছিলাম আপনাকে আর কেউ খোজ করবে না, আপনি এখন নূতন জীবন। শুরু করতে পারবেন।
আমি খবরের কাগজটি দেখিয়ে বললাম, আমি পুড়ে মারা গেছি, এখন যখন দেখবে দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছি—
লুকাস মাথা নেড়ে বলল, দেখবে না। আপনাকে নৃতন একটা পরিচয় দেয়া হবে। চোখের আইরিশ পাল্টে আপনার পরিচয় পাল্টে দেয়া হবে।
কিন্তু চোহারা? এই চেহারা?
খুব ঘনিষ্ঠ কয়েকজন ছাড়া আর কেউ তো চেহারা দিয়ে পরিচয় রাখে না। আপাতত আপনি আপনার ঘনিষ্ঠ কারো কাছে যাচ্ছেন না। মানুষের চেহারা খুব সহজে পাল্টে দেয়া যায়, তাই তার সত্যিকার পরিচয় চোখের আইরিশে, চেহারায় নয়। কাজেই আপনাকে কেউ কোনোদিন শনাক্ত করতে পারবে না, আপনি নিশ্চিত থাকেন।
লুকাস খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, অবশ্যি আপনি নিজে যদি কর্মকর্তাদের কাছে গিয়ে সবকিছু স্বীকার করেন সেটা ভিন্ন কথা। কিন্তু আমি আশা করছি আপনি সেটা করবেন না, আপনার যদিও ক্রুগো কম্পিউটারের জন্যে খানিকটা শান্তা আছে, আপনার জন্যে তার বিন্দুমাত্র মমতা নেই।
আমি লুকাসের খোঁচাটা হজম করে চুপ করে থাকি। লুকাস আবার বলে, কর্মকর্তাদের কাছে গিয়ে আপনার পরিচয় দেয়ার আমি কোনো কারণ দেখছি না। নৈতিক কর্তব্য বিবেচনা করে আপনি যদি আমাদের যড়যন্ত্রের কথা বলে দিতে চান, বলতে পারেন। ক্রুগো কম্পিউটারের কাছে সেটা নুতন খবর নয়, সে অনেকদিন থেকে আমাকে খুজে যাচ্ছে। গত রাতে আপনার মস্তিষ্ক স্ক্যানিং বন্ধ করিয়ে পালানোর ব্যবস্থা করার পর নীষার পক্ষে তার পুরান কাজে ফিরে যাওয়া বিপজ্জনক; সে আর সেখানে যাবে না। আপনি তাই তাকেও ধরিয়ে দিতে পারবেন না। আমি আশা করছি আপনার নিজের প্রাণের মায়ায় আপনি এ-ধরনের চেষ্টা করবেন না।
লুকাস উঠে দাঁড়িয়ে বলল, আপনার জন্যে আমরা শহরতলিতে একটা অ্যাপার্টমেন্ট ঠিক করেছি। আজ বিকেলেই আপনি সেখানে উঠে যাবেন, এখানে থাকাটা আপনার জন্যে বিপজ্জনক। এরপর আপনি আর আমাদের সাথে যোগাযোগ করতে পারবেন না। আমরা অবশ্যি আপনার সাথে যোগাযোগ রাখব। আমি আশা করছি কোনোদিন আপনি ক্রুগো কম্পিউটারের সত্যিকার পরিচয় জানবেন, তখন আপনি আমাদের সাহায্য করতে রাজি হবেন।
লুকাস মাথা নেড়ে আমাকে অভিবাদন করে বের হয়ে গেল। আমি আর নীষা চুপচাপ বসে রইলাম, কোথায় জানি সুর কেটে গেছে, আর সহজ স্বাভাবিক কথা বলা যাচ্ছে না। আমি খানিকক্ষণ ইতস্তত করে বললাম, তোমরা আমাকে বাঁচানোর জন্যে যা করেছ আমি তার জন্যে কৃতজ্ঞ। কিন্তু সে জন্যে আমি তো মানুষের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারি না।
নীষা কোনো কথা না বলে চুপ করে থাকে।
তুমি ক্ৰগো কম্পিউটার নিয়ে কিছু-একটা কথা বলতে চাইছিলে, আমি শুনতে রাজি হই নি, তুমি নিশ্চয়ই বুঝতে পারছ কেন? কারণ তোমরা যাই বল, আমার পক্ষে সেটা বিশ্বাস করা সম্ভব না। আমি মানুষ, এ ব্যাপারে বিশ্বাসযোগ্য জিনিস আমি শুধু মানুষের মুখ থেকে শুনতে পারি।
নীষা আমার দিকে চোখ তুলে তাকাল, তার মুখে হঠাৎ একটা আশ্চর্য হাসি ফুটে উঠেছে, আস্তে আস্তে বলল, আমি যদি বলি আমি রবোট্রন নই, আমি মানুষ?
কিন্তু তুমি জান সেটা প্রমাণ করা কত কঠিন।
নীষা আস্তে আস্তে মাথা নাড়ে, জানি।
তুমি আমাকে ভুল বুঝো না, নীষা।
না, ভুল বুঝব না। সে একটা ছোট দীর্ঘশ্বাস ফেলে চুপ করে যায়।
এই সময়ে ভিকি এসে হাজির হল, কিম জুরান।
বল।
লুকাস বলেছে আপনার আইরিশ পাল্টে দিতে। আপনি আসুন আমার সাথে।
আমি আস্তে আস্তে বললাম, ব্যথা করবে না তো?
ব্যথা? সেটা কী?
আমি হাল ছেড়ে দিলাম।
গাড়ি চালাচ্ছে নীষা, আমি পাশে চুপচাপ বসে আছি। দু’ জন কথা না বলে চুপচাপ বসে থাকা খুব কষ্টকর। কিন্তু কোথায় যেন সুর কেটে গেছে, চেষ্টা করেও আর কথা বলতে পারছি না। দীর্ঘক্ষণ চুপ করে থাকার পর নীষা বলল, আপনার চোখে এখনো ব্যথা আছে?
না, নেই। আমি জানতাম না ব্যাপারটা কষ্টকর।
ইচ্ছে করলে চোখ অবশ করে নেয়া যায়, সাধারণত করা হয় না।