ও, সেইসব? অবশ্যি আছে। কী আনব?
নীষা জানতে চায়, কী কী আছে?
লাল বাক্স, সবুজ বাক্স আর নীল বাক্স। ছোট, বড় আর মাঝারি। ভেতরে আছে ট্যাবলেট, ক্যাপসুল আর তরল। ট্যাবলেট–
নীষা বাধা দিয়ে বলল, থাক আর বলতে হবে না।
কোনটা আনব?
তোমার আনতে হবে না, আমরা নিজেরা ব্যবস্থা করে নেব। কিম জুরান, চলুন রান্নাঘরে বসে কথা বলা যাবে, লুকাস, তুমিও আস।
হ্যাঁ, চল।
রান্নাঘরে টেবিলে নাস্তা করতে করতে কথা হচ্ছিল। লুকাস অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে টেবিলে আঙুল দিয়ে শব্দ করছিল, আমি খানিকক্ষণ ইতস্তত করে জিজ্ঞেস করলাম, তোমাদের একটা জিনিস জিজ্ঞেস করব?
করুন।
আমাকে বাঁচানোর জন্যে তোমরা এত কষ্ট করলে কেন?
কৃতজ্ঞতা বলতে পারেন।
কৃতজ্ঞতা?
আপনি আমার প্রাণ বাঁচিয়েছিলেন, আমি তাই যেটুকু সম্ভব চেষ্টা করেছি। আপনার প্রাণ বাঁচানোর জন্যে।
আমি লুকাসের চোখের দিকে তাকিয়ে হেসে বললাম, মানুষ বহুকাল থেকে মিথ্যে কথা বলে আসছে, তাই তারা যখন মিথ্যে বলে, ধরা খুব কঠিন। কিন্তু রবোটেরা মিথ্যে কথা বলা শুরু করেছে মাত্র অল্প কিছুদিন হল, তারা যখন মিথ্যে কথা বলে, ধরা খুব সহজ।
লুকাস সরু চোখে বলল, কেন, আমি কি মিথ্যে কথা বলেছি?
আমি তোমাকে আরো একবার এই প্রশ্ন করেছিলাম, মহাকাশযানে রুকুন গ্রহপুঞ্জে যাবার সময়, তখন তুমি অন্য উত্তর দিয়েছিলে।
আমি কী বলেছিলাম?
বলেছিলে তুমি আমাকে বাঁচাতে এসেছ, নীষার অনুরোধে। আমার জন্যে নীষার মায়া হয়েছিল—
লুকাস বাধা দিয়ে বলল, সেটা সত্যি। নীষা আমাকে অনুরোধ করেছিল; আমার নিজেরও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করার একটা সুযোগ হল।
আমি মাথা নাড়লাম, না, কোথায় জানি হিসেব মিলছে না। এত কষ্ট করে আমাকে বাঁচালে, এত বড় বড় ঝুঁকি নিলে দু জনে, শুধু মায়া আর কৃতজ্ঞতাবোধে হয় না,–
লুকাস বাধা দিয়ে কী-একটা বলতে যাচ্ছিল, নীষা হাত তুলে থামিয়ে দিয়ে বলল, লুকাস, সত্যি কথাটা বলে দাও।
লুকাস চমকে নীষার দিকে তাকায়, খানিকক্ষণ কোনো কথা নেই, তারপর এটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে চেয়ারে হেলান দিয়ে বলল, আমি দুঃখিত কিম জুরান, আপনার কাছে সত্যি কথাটি গোপন করার জন্যে। আপনি নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন আপনাকে কী জন্যে আমরা এত কষ্ট করে বাঁচিয়ে রেখেছি।
হ্যাঁ। আমি মাথা নাড়লাম, যে-কারণটির জন্যে আমাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছিল ঠিক সেই কারণে আমি তোমাদের কাছে মূল্যবান। ঠিক?
ঠিক।
তোমরা জানতে চাও আমি কীভাবে গো কম্পিউটারের গোপন সংকেত বের করে তার ভেতর থেকে খবর বের করার চেষ্টা করেছিলাম।
হ্যাঁ।
সেটি গোপন করছিলে কেন?
লুকাস কোনো কথা না বলে মাথা নিচু করে। নীষা আস্তে আস্তে বলল, কারণটা খুব সহজ, রবোটেরা সব সময়ে এক ধরনের হীনমন্যতায় ভোগে। তাই তারা কখনোই ঠিক বিশ্বাস করতে পারে না যে একজন মানুষ তাদের কোনো ধরনের অভ্যুথানে সাহায্য করবে।
আমি নীষার দিকে তাকিয়ে বললাম, নীষা, পৃথিবীর কিছু মানুষ হয়তো আমার উপর অবিচার করেছে, কিন্তু সে জন্যে আমি সব মানুষের বিরুদ্ধে গিয়ে রবোটের অভ্যুথানে সাহায্য করতে পারি না।
রবোটের অভ্যুত্থান হলেই সেটা মানুষের বিরুদ্ধে হবে কেন ধরে নিচ্ছেন?
তাহলে কার বিরুদ্ধে হবে?
রবোটের অ্যুথান হবে অন্য রবোটের বিরুদ্ধে, ক্রুগো কম্পিউটারের বিরুদ্ধে।
আমি একটু উষ্ণ হয়ে বললাম, ক্রুগো কম্পিউটারের উপর আমার নিজের যত ব্যক্তিগত আক্রোশই থাকুক না কেন, তোমরা অস্বীকার করতে পারবে না সেটা তৈরি করেছে মানুষ, মানুষকে সাহায্য করার জন্যে। আমি কখনোই কিছু রবোটকে সেটা
ধ্বংস করতে দেব না।
নীষা একটু ঝুঁকে পড়ে বলল, আপনি সবকিছু জানেন না কিম জুরান। যদি জানতেন—
আমি মাথা নেড়ে বললাম, পৃথিবীর কেউ সবকিছু জানে না নীষা, বেঁচে থাকতে হলে সবকিছু জানতে হয় না। যেটুকু প্রয়োজন সেটুকু জানলেই হয়। রবোটের প্রয়োজন আর মানুষের প্রয়োজন এক নয়, তাই রবোটের যেটা জানতে হয়, মানুষের সেটা জানার প্রয়োজন নাও হতে পারে।
নীষা একটু উত্তেজিত হয়ে বলল, আমি কী বলতে চাইছি, আপনি একবার শুনবেন না?
না। আমি কঠোর গলায় বললাম, না। তোমরা আমাকে মানুষের বিরুদ্ধে কাজ করাতে পারবে না। আমি কঠোর স্বরে বললাম, তোমরা কীভাবে আশা করতে পার যে আমি তোমাদের বিশ্বাস করব? ঐ ঘরের বড় যন্ত্রপাতি কি আমার মস্তিষ্ক স্ক্যানিং করার জন্যে তৈরি হয় নি?
নীষা আর লুকাস দু’ জনেই চমকে ওঠে। নীষা কাতর গলায় বলল, হ্যাঁ, কিন্তু আপনি বিশ্বাস করুন, তার প্রয়োজন হবে না, আমার সব কথা শুনলে আপনি নিজেই। সাহায্য করবেন। আপনি বিশ্বাস করুন—
আমি মুখ শক্ত করে বললাম, আমি রবোটকে বিশ্বাস করি না।
নীষা আহত মুখে আমার দিকে তাকিয়ে চুপ করে গেল।
লুকাস এতক্ষণ একটি কথাও না বলে চুপ করে ছিল। এবারে আস্তে আস্তে বলল, আমার খুব আশাভঙ্গ হল কিম জুরান। আমার আশা ছিল আপনি হয়তো সব শুনে আমাদের সাহায্য করবেন। কিন্তু আপনি করলেন না। এখন আপনার মস্তিষ্ক স্ক্যানিং করা ছাড়া আর কোনো উপায় রইল না।
আমার মুখে একটা আশ্চর্য হাসি ফুটে ওঠে। লুকাস সেটা লক্ষ না করার ভঙ্গি করে বলল, কিন্তু আমরা আপনার মস্তিষ্ক স্ক্যানিং করব না। একজন মানুষের উপর এত অবিচার করা যায় না।
তাহলে কী করবে?
এখনো ঠিক করি নি। আমাদের নিজেদের ক্রুগো কম্পিউটারের সংকেত বের করতে হবে, সে জন্যে সময় লাগবে।