আমি তার সাথে পাশের একটা ঘরে হাজির হলাম। সাদা একটা বিছানায় আমাকে শুইয়ে দিয়ে সে আমার উপর ঝুঁকে পড়ে। তার বিপজ্জনক কনুই থেকে যতদূর সম্ভব নিজেকে বাঁচিয়ে রেখে আমি আলাপ জমানোর চেষ্টা করি, অনেকদিন থেকে আছ বুঝি?
তা বলতে পারেন, আপনাদের হিসেবে তো অনেক দিনই।
কত দিন?
এক শ’ তিরিশ বছর। কপোট্রনের এনালাইজিং ইউনিটটা অবশ্যি নতুন, গত বছর ঢোকানো হয়েছে। কিন্তু পুরান জিনিস গছিয়ে দিয়েছে।
কানের কাছে ঐ তারগুলো কিসের?
ভিকি বিরক্ত হয়ে বলল, আর বলবেন না, লুকাসের কাণ্ড। মাঝে মাঝে দাবা খেলার জন্য আমার ভেতরে গ্রান্ড মাস্টারের মেমোরি লোড করে। রেডিও ফ্রিকোয়েন্সিতে করতে নাকি দেরি হয়, তাই এই তারগুলো বের করে রেখেছে, সোজা প্লগ ইন করে দেয়।
ও, আচ্ছা। আমি একটু সমবেদনা প্রকাশ না করে পারলাম না, একটু ঢেকেঢুকে রাখলেই পার।
আর ঢেকেঢুকে কী হবে? কতদিন থেকে বলছি আমার বাইরের চেহারাটা ঠিক করে দাও, দিচ্ছি দিচ্ছি করে কত দেরি করল দেখেছেন? লুকাসের মতো আলসে মানুষ আছে নাকি?
ব্যস্ত মানুষ, আমি লুকাসের পক্ষ টেনে কথা বলার চেষ্টা করি, কত কিছু করতে হয়।
ভিকি বাম হাতটা যত্ন করে ব্যান্ডেজ করে দিতে দিতে বলল, আপনাকে বেশ শ্রদ্ধা-ভক্তি করে বলে মনে হল, বলে দেখবেন তো আমার চেহারাটা ঠিক করে দিতে।
বলব।
হ্যাঁ, বলবেন। কতদিন ঘরের বাইরে যেতে পারি না এই চেহারার জন্যে। খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে ভিকি বলল, লুকাস ছেলেটা আসলে খারাপ নয়, তবে ভারি ফাঁকিবাজ।
আমি একটু ইতস্তত করে জিজ্ঞেস করলাম, তুমি নীষাকে চেন?
হ্যাঁ, চিনি।
ও কি মানুষ, নাকি রবোট্রন?
ভিকির চেহারাতে অনুভূতির কোনো ছাপ পড়ে না, তাই ঠিক বুঝতে পারলাম না ও কী ভাবছে। খানিকক্ষণ চিন্তা করে বলল, জানি না। দেখে মনে হয় মানুষ। কিন্তু নূতন রবোটন গুলোর সাথে মানুষের কোনো পার্থক্য বোঝা যায় না। নীষা কথাও বলে চমৎকার, রবোট্রনের মতো, মানুষের ন্যাকামোর কোনো চিহ্ন নেই। আপনি কিছু মনে করলেন না তো?
আমি কথাটা হজম করে বললাম, মানুষ হলেই ন্যাকামো করে?
করবে না? ওদের মস্তিস্কেই কিছু-একটা গণ্ডগোল আছে।
আমিও করেছি?
করলেন না? জিজ্ঞেস করলেন নীষা মানুষ, না রবোট্রন! এটা ন্যাকামো হল না? একজন রবোট কখনো এসব প্রশ্ন করবে না। ভিকি খানিকক্ষণ চিন্তা করে মাথা নেড়ে বলল, আমার কী মনে হয় জানেন?
কী?
নীষার জন্যে আপনার প্রেম হচ্ছে।
আমার কানের গোড়া পর্যন্ত লাল হয়ে উঠল। একটু কেশে বললাম, তোমার তাই মনে হয়?
হুঁ। আমি অবশ্যি এসব বুঝি না, আমাদের সময় ওসব ছিল না। আজকাল নাকি রবোটে প্রেম-ভালবাসা এসব দেয়া হচ্ছে। শুধু শুধু সময় নষ্ট।
ভিকির মুখে অনুভূতির ছাপ পড়ে না, তা না হলে এখন নিশ্চয়ই তার ভুরু বিরক্তিতে কুঁচকে উঠত।
আপনি এখন ঘুমান, আপনার বিশ্রাম দরকার।
ভিকি আমার চারপাশে কম্বল গুজে দিয়ে, বাতি নিভিয়ে বলল, কিছু দরকার হলে বলবেন, আমি আশেপাশেই আছি।
আমি সাথে সাথেই ঘুমিয়ে পড়লাম, গভীর নিরুদ্বেগ ঘুম, বহুকাল এভাবে ঘুমাই নি। মাঝে কয়েক মুহূর্তের জন্যে ঘুম ভেঙে গিয়েছিল, খানিকক্ষণ সময় লাগল বোঝার জন্যে কোথায় আছি। যখন মনে পড়ল আর আমার মৃত্যুদণ্ডের জন্যে অপেক্ষা করতে হবে না, গভীর শান্তিতে আমি পাশ ফিরে আবার ঘুমিয়ে পড়লাম।
০৮. মতবিরোধ
৮. মতবিরোধ
সকালে যখন আমার ঘুম ভাঙল তখন বেশ বেলা হয়ে গেছে। আমি তবু বেশ অনেকক্ষণ শুয়ে রইলাম, বহুকাল এভাবে শুয়ে থাকি নি। একসময় লোকজনের গলার আওয়াজ আসতে থাকে, একজন মেয়ের গলাও পেলাম, নিশ্চয়ই নীষা এসেছে। আমি তখন আড়মোড়া ভেঙে উঠে পড়লাম।
পাশে একটা ছোট বাথরুম, আমার কাপড়জামা সেখানে পাট করে সাজানো। আমি নিজেকে পরিষ্কার করে, ধোয়া কাপড় পরে বেরিয়ে আসি। গলার শব্দ অনুসরণ করে খানিকদূর যেতেই একটা বড় ঘরে এসে হাজির হলাম. ঘরটিতে যে-পরিমাণ যন্ত্রপাতি আমার মনে হয় না পথিবীর আর কোথাও এত অল্প জায়গায় এত যন্ত্রপাতি রাখা হয়েছে। ঘরের এক কোনায় একটা ছোট টেবিল ঘিরে কয়েকটা চেয়ার, তার দু’টিতে নীষা আর লুকাস বসে কথা বলছে, আমাকে দেখে দু’ জনেই ঘুরে তাকায়। লুকাস হাত নেড়ে বলল, আসুন কিম জুরান,পনার জন্যে অপেক্ষা করছি। ভালো ঘুম হয়েছিল তো?
হ্যাঁ, অনেকদিন পর ভালো ঘুম হল। আমি চারদিকে অসংখ্য ইলেকট্রনিক মডিউল দেখতে দেখতে বললাম, এ-কি সর্বনাশা যন্ত্রপাতি, কী এটা?
জানবেন, সময় হলেই জানবেন।
গোপন কিছু নাকি?
আমরা যেহেতু বেআইনি মানুষ, আমাদের সবকিছুই গোপন। আপনার কাছে অবশ্যি গোপন করার কিছুই নেই।
নীষা জিজ্ঞেস করল, সকালে কিছু খেয়েছেন?
না, খাইনি। ভোরে অবশ্যি এমনিতেই আমার কিছু খেতে ইচ্ছা করে না।
লুকাস মাথা নেড়ে বলল, রবোট হলে এই হচ্ছে মুশকিল, নিজের খেতে হয় না বলে মনেই থাকে না যে অন্যদের খাওয়ার প্রয়োজন হতে পারে। দাঁড়ান, আপনার খাবার ব্যবস্থা করে দিচ্ছি। লুকাস উচ্চস্বরে ডাকে, ভিকি, ভিকি—
ভিকি ঘরে এসে আমাকে খানিকক্ষণ পর্যবেক্ষণ করে বলল, রক্তপাত বন্ধ হয়েছে?
হ্যাঁ, তোমাকে অনেক ধন্যবাদ।
লুকাস বলল, ভিকি খাবারের ব্যবস্থা কর।
খাবার? ভিকি বিচলিত হয়ে বলল, খাবার কী জিনিস?
লুকাস ধৈর্য না হারিয়ে বলল, মানুষ যেসব জিনিস খায়, যেগুলো না খেলে মানুষ দুর্বল হয়ে পড়ে। আছে সেসব?