ড্রাইভার-সীটে যে বসে আছে তাকে দেখতে পাচ্ছিলাম না, কমবয়স্ক একজন। তরুণ, স্টিয়ারিংয়ের উপর ঝুঁকে পড়ে রাস্তা থেকে চোখ না সরিয়ে বলল, আপনার নূতন জীবন শুরু হল কিম জুরান।
লুকাস!
লুকাস হাসিমুখে আমার দিকে ঘুরে বলল, বাম হাতে গুলি লেগেছে, শক্ত করে চেপে ধরে রাখুন।
গুলি? কার? বলে আমি তাকিয়ে দেখি সত্যি আমার বাম হাত চুইয়ে রক্ত পড়ছে, তাড়াতাড়ি ডান হাত দিয়ে চেপে ধরে ভয়ার্ত গলায় বললাম, সর্বনাশ! কখন গুলি লাগল?
মাঝামাঝি যখন ছিলেন। কিছু হয় নি, ভয় পাবেন না। উত্তেজনার মাঝে টের পান নি, চামড়া ছড়ে গেছে একটু, আমি দেখেছি। লুকাস আমার দিকে তাকিয়ে হেসে বলল, আপনার কোনো ভয় নেই। যে-মানুষ রুকুন গহপুঞ্জে গিয়ে ঠিক ঠিক ফিরে আসতে পারে, তাকে স্বয়ং বিধাতা নিজের হাতে রক্ষা করবে।
বাঁচিয়েছিলে তো তুমি। আমি একটা রুমাল দিয়ে হাত বাঁধতে বাঁধতে বললাম, ধন্যবাদ দেবার সুযোগ হয় নি।
আমি বাঁচিয়েছিলাম! কী আশ্চর্য!
কেন? এতে আশ্চর্যের কী আছে!
আমি জানি না, তাই অবাক লাগছে!
আমি বিস্মিত হয়ে বললাম, তুমি জান না মানে?
আমার স্মৃতির একটা অংশ পাঠানো হয়েছিল, সে কখনো ফিরে আসে নি।
রে আসে নি?
না, মহাকাশযানের মূল কম্পিউটারকে ধ্বংস করার সময় নিজেও ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। আপনাকে একদিন বলতে হবে কী হয়েছিল।
আমি কী-একটা বলতে যাচ্ছিলাম, লুকাস হাত তুলে আমাকে থামিয়ে দিয়ে, একটা চৌকা মতন বাক্সে নিচু স্বরে কার সাথে জানি কী-একটা কথা বলে, তারপর একটা সুইচ টিপে দিতেই প্রচণ্ড একটা বিস্ফোরণের আওয়াজ পেলাম। খুব কাছেই আগুনের একটা গোলা সশব্দে উপরে উঠে ফেটে যায়, তার মাঝে দিয়ে লুকাস গাড়িটাকে বের করে এনে শান্ত স্বরে জিজ্ঞেস করল, হা, কী জানি বলছিলেন?
আমি শুকনো গলায় বললাম, কিসের বিস্ফোরণ ওটা?
একটা গাড়ি ধ্বংস হয়ে গেল।
কার গাড়ি?
লুকাস মুখ টিপে হাসতে হাসতে বলল, এখন বলব না, কাল ভোরে খবরের কাগজে দেখবেন।
আমি কিছু না বুঝে খানিকক্ষণ লুকাসের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকি। লুকাস সহজ স্বরে বলল, বেল্ট দিয়ে শক্ত করে বাঁধা আছেন তো?
আছি।
বেশ! একটু সতর্ক থাকবেন কথা বলতে বলতে লুকাস হঠাৎ মাঝপথে গাড়িটা ঘুরিয়ে নেয়, আমি প্রায় ছিটকে উড়ে বেরিয়ে যাচ্ছিলাম, তার মাঝে হঠাৎ দেখি গাড়িটা মাথা উপরে তুলে মাটি থেকে দশ-বার ফুট উপর দিয়ে উড়তে শুরু করেছে।
বাই ভার্বাল! আমি বিস্মিত হয়ে বললাম, বাই ভার্বাল গাড়ি বেআইনি না?
আমরা নিজেরাই তো বেআইনি, লুকাস গাড়িটাকে উড়িয়ে নিতে নিতে বলল, আমাদের গাড়ি বেআইনি না হলে কি মানায়?
আমি নিচে তাকিয়ে দেখি গাড়িটা রাস্তা ছেড়ে মাঠ-ঘাট-বন-বাদাড় পার হয়ে কিছুক্ষণের মাঝেই আবার লোকালয়ে ফিরে আসে। নির্জন একটা রাস্তাতে গাড়িটা আবার নিচে নামিয়ে লুকাস যেন একজন ভদ্রলোকের মতো গাড়ি চালিয়ে একটা পুরান বিল্ডিংয়ের সামনে এসে দাঁড়াল।
গাড়ির দরজা খুলতে খুলতে লুকাস বলল, আপনি একটু দাঁড়ান, অনেক কিছু ঘটেছে আজ, গাড়ির লগটা দেখে আসি, সবকিছু ঠিকঠিক করে হয়েছে কী না। পেছনে পুলিস লেগে থাকলে বিপদ হতে পারে। গাড়ির কম্পিউটারে কী-একটা দেখে সে ভারি খুশি হয়ে উঠে বলল, চমৎকার। একেবারে পেশাদারের কাজ!
বিল্ডিংটা বাইরে থেকে পুরান মনে হলেও ভেতরে একেবারে অন্যরকম। দরজা খুলে ভেতরে ঢুকতেই আমাদের দিকে একজন এগিয়ে আসে। দেখেই বোঝা যায় সে একজন রবোট্রন। শুধু যে কপালের উপর কয়েকটা স্কু রয়েছে তাই নয়, কানের নিচে থেকে কয়েকটা তারও বের হয়ে আছে। লুকাসকে মানুষের মতো দেখানোর জন্যে যেটুক পরিশ্রম করা হয়েছে, এর জন্যে তা করা হয় নি। লুকাস এই রবোটটির দিকে তাকিয়ে কী-একটা বলল, শুনে রবোটটি মাথা নেড়ে আমাদের দিকে এগিয়ে আসে।
লুকাস আমাকে বলল, আপনি ভিকির সাথে যান। ও আপনার দেখাশোনা করবে।
তুমি?
আমি একটু কন্ট্রোলরুমে যাই। নীষার কোনো সাহায্য লাগবে কি না দেখি।
নীষা? ওর কি কোনো বিপদ হতে পারে?
হতে তো পারেই, যেসব কাজকর্ম করে, বিপদ হওয়া আর বিচিত্র কি! কিন্তু হবে না, আপনি নিশ্চিন্ত থাকেন।
আমি যেতে যেতে আবার ঘুরে দাঁড়ালাম, নীষা কি রবোট্রন?
লুকাস আমার চোখের দিকে তাকাল, আমি মহাকাশযানে ওকে এই প্রশ্নটি করেছিলাম, ও জানে না। ওর দৃষ্টির সামনে আমি কেন জানি লজ্জা পেয়ে যাই। লুকাস সেটা গ্রাহ্য না করে বলল, নীষা রবোর্টুন হলে আপনার মন-খারাপ হয়ে যাবে?
মন-খারাপ হবে কেন?
হবে হবে, আমি জানি হবে। লুকাস চোখ নাচিয়ে বলল, আমি বলব না, দেখি আপনি বের করতে পারেন কিনা।
আমি একটা নিঃশ্বাস ফেললাম, আগেও সে একই উত্তর দিয়েছিল।
ভিকি নামের রবোটটি আমাকে পেছন থেকে ঠেলে দিয়ে কাঠ কাঠ স্বরে বলল, চলুন, আপনার রক্তপাত বন্ধ করা দরকার।
লুকাস ভিকিকে একটা ধমক দিয়ে বলল, তোমাকে কতবার বলেছি কনুইয়ের কাছে শর্ট সার্কিটটা সেরে ফেল, যখনই দেয়ালের কাছে আসছ কেমন স্পার্ক বের হচ্ছে দেখেছ?
ভিকি সরল মুখে বলল, কী আছে, মাত্র তো আঠার হাজার ভোল্ট।
আঠার হাজার ভোল্ট তোমার কাছে মাত্র হতে পারে, কিন্তু কিম জুরানের জন্যে মাত্র নয়। ইনি একজন মানুষ, তোমার মতন রবোট নয়। তোমার থেকে একটা স্পার্ক খেলে কিম জুরানকে আর দেখতে হবে না!
ও, আচ্ছা। ভিকিকে খুব বেশি বিচলিত মনে হল না, আমাকে আবার পেছন থেকে ঠেলে দিয়ে বলল, চলুন, আপনার রক্তপাত বন্ধ করা দরকার।