আমি প্রাণপণ চেষ্টা করে নিজের উত্তেজনাকে দমিয়ে স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করতে থাকি। নীষা খানিকক্ষণ সময় দিয়ে আবার কথা বলতে শুরু করে, বুঝতেই পারছেন আমি আপনার মস্তিষ্ক স্ক্যানিং বন্ধ করে দিয়েছি, কাজটি খুব গোপনে করতে হয়েছে। ভয়ংকর বিপজ্জনক কাজ এটি, ধরা পড়লে আমার এবং আপনার দু’জনেরই আবার রুকুন গ্ৰহপুঞ্জে যেতে হতে পারে! যাই হোক আমি দুঃখিত, ঠিক সময়মতো বন্ধ করতে পারলাম না, নিরাপত্তার যেসব নৃতন ব্যবস্থা করা হয়েছে সেগুলোর জন্য একটু দেরি হল। আপনার শৈশবের কিছু স্মৃতি হারিয়েছেন আপনি, আমি সেজন্যে দুঃখিত। এখন আপনাকে অভিনয় করতে হবে। প্রথম অংশটুকু সোজা, পরবর্তী এক ঘন্টা চুপচাপ শুয়ে থাকবেন চোখ বন্ধ করে। এর পরের অংশটুকু কঠিন, আপনাকে দেখাতে হবে যে আপনার কোনো স্মৃতি নেই। জিনিসটা সহজ নয়, কিন্তু সৌভাগ্যক্রমে এরকম অবস্থায় একেকজন মানুষ একেক রকমভাবে ব্যবহার করে। কাজেই আপনার নিজের ইচ্ছেমতো কোনো-একটা কিছু করার স্বাধীনতা আছে। চেষ্টা করবেন একটা উদ্ভ্রান্ত দৃষ্টি দিয়ে তাকাতে, অল্পতেই চমকে উঠবেন এবং খুব সহজে ভয় পেয়ে যাবেন। কোনো অবস্থাতেই দু’টি জিনিস করবেন না, একটি হচ্ছে কথা বলা, আরেকটি হচ্ছে কারো কথা শুনে বুঝতে পারা! একটিমাত্র জিনিস আপনি উপভোগ করতে পারেন, সেটা হচ্ছে সংগীত।
নীষা হঠাৎ গলা নামিয়ে বলল, আমি এখন আর কথা বলতে পারব না, এখন সবকিছু আপনার উপর নির্ভর করছে।
হঠাৎ করে সবকিছু নীরব হয়ে যায়। আমি চুপচাপ শুয়ে থাকি। চোখ বন্ধ করে এক ঘন্টা শুয়ে থাকা সহজ ব্যাপার নয়, আমার মনে হল প্রায় এক যুগ থেকে শুয়ে আছি! একসময় এদিকে-সেদিকে কয়েকটা বাতি জ্বলে ওঠে। এতক্ষণ যে মৃদু গুঞ্জন হচ্ছিল সেটা থেমে যায় এবং কয়েকজন ডাক্তার নিঃশব্দে আমাকে ঘিরে দাঁড়ায়। আমি চোখ খুলে তাকাতেই ডাক্তারেরা সহৃদয়ভাবে হাসার চেষ্টা করল। আমি ভয় পেয়ে যাবার একটা ভঙ্গি করলাম। নিশ্চয়ই অতি অভিনয় হয়ে গিয়েছিল, কারণ ডাক্তারেরা ছিটকে পেছনে সরে এসে খানিকক্ষণ ফিসফিস করে নিজেদের ভেতর কথা বলে বাতিগুলো নিভিয়ে একটা কোমল সংগীত বাজানোর ব্যবস্থা করে চলে গেল।
আমি একা একা আবছা অন্ধকারে শুয়ে থাকি। গোপন কোনো জায়গা থেকে আমাকে লক্ষ করা হচ্ছে কী না আমি জানি না, তাই আমি অস্বাভাবিক কিছু করার সাহস পেলাম না, এক ভঙ্গিতে ছাদের দিকে তাকিয়ে শুয়ে রইলাম। কতক্ষণ শুয়ে ছিলাম জানি না, একসময় হঠাৎ নীষার গলার আওয়াজ পেলাম, কিম জুরান।
আমি ঘুরে তাকাই, নীষা কখন নিঃশব্দে আমার মাথার কাছে এসে দাঁড়িয়েছে। তার হাতে একটা সাদা পোশাক, আমার হাতে দিয়ে ফিসফিস করে বলল, এটা পরে নিন।
আমি পোশাকের ভাঁজ খুলতে খুলতে নিচু স্বরে জিজ্ঞেস করলাম, এখন কী হবে?
আপনার দুই মিনিট সময় আছে এখান থেকে পালাবার।
দুই মিনিট? আমি থতমত খেয়ে বললাম, কীভাবে পালাব আমি? কিছুই তো চিনি না।
বলছি, মন দিয়ে শুনুন। প্রথমে সোজা হেঁটে যাবেন করিডোর ধরে, শান্তভাবে, কোনোরকম উত্তেজনা দেখাবেন না। কারো সাথে দেখা হলে কিংবা কেউ কোনো কথা বলতে চাইলে পুরোপুরি অগ্রাহ্য করবেন। করিভোরের শেষ মাথায় দরজাটা খোলামাত্র জরুরি বিপদ সংকেত জানিয়ে সব ক’টা দরজা নিজে নিজে বন্ধ হয়ে যাবার কথা। আমি ব্যবস্থা করেছি যেন কয়েকটা খোলা থাকে, কোনো জটিল কিছু নয়, দরজার ফাঁকে ফাঁকে একটা করে দিয়াশলাইয়ের কাঠি রেখে এসেছি। যাই হোক, ঠিক ঠিক। দরজাগুলো দিয়ে বিল্ডিংয়ের বাইরে এসে বাম দিকে দৌড়াবেন। হাঁটা নয়, দৌড়। আমি জানি আপনার যে অবস্থা তাতে দৌড়ানো খুব সহজ ব্যাপার নয়, কিন্তু তবু বলছি দৌড়াবেন। যদি এক সেকেন্ড সময়ও বাঁচাতে পারেন আপনার পালানোর সম্ভাবনা দশ গুণ বেড়ে যাবে। আর সবচেয়ে যেটা ভয়ের কথা সেটা হচ্ছে, যদি দেরি হয়ে যায় তাহলে কন্ট্রোল টাওয়ারে গার্ডেরা পৌছে যাবে, সেখান থেকে গুলি করার চেষ্টা করতে পারে। যাই হোক, দেয়াল ঘেঁষে থাকবেন, শেষ মাথায় একটা গাড়ি থাকবে, হেড লাইট নিভিয়ে, কিন্তু দরজা খোলা রেখে, লাফিয়ে উঠে পড়বেন গাড়িতে, তাহলেই আপনার দায়িত্ব শেষ।
আমি সাদা পোশাকটার বোতাম লাগাতে লাগাতে বললাম, দরজাগুলো কোথায় বলে দাও।
শুনুন মন দিয়ে, একটা ভুল দরজা খোলার চেষ্টা করলে অন্তত দশ সেকেন্ড সময় নষ্ট, কাজেই সাবধান।
কিছুক্ষণের মাঝেই নীষা আমাকে রওনা করিয়ে দিল। পরবর্তী দুই মিনিট সময়কে আমি আমার জীবনের দীর্ঘতম সময় বলে বিবেচনা করব। কর্কশ অ্যালার্মের শব্দের মাঝে মাথা ঠাণ্ডা রেখে ঠিক ঠিক দরজাগুলো খুলে খুলে যাওয়া খুব সহজ ব্যাপার নয়, বিশেষ করে আমি যখন উত্তেজনার মাঝে কিছুতেই মাথা ঠাণ্ডা রাখতে পারি না। শেষ অংশটুকু, যেখানে আমার দেয়ালের পাশ দিয়ে দৌঁড়ে যাবার কথা, সেখানে আমি কিছুতেই দৌড়াতে পারছিলাম না। পায়ের মাংসপেশীর তখনো দৌড়ানোর মতো ক্ষমতা হয় নি। এই সময়ে বারকয়েক হাততালির মতো শব্দ শোনা গেল, পরে বুঝেছিলাম সেগুলো শক্তিশালী রাইফেলের গুলি।
দেয়ালের শেষ মাথায় সত্যি সত্যি একটা গাড়ি দাঁড়িয়ে ছিল, হেড লাইট নেভানো কিন্তু দরজা খোলা, ইঞ্জিন ধকধক করে শব্দ করছে। আমি লাফিয়ে ওঠামাত্র দরজা বন্ধ হয়ে গেল এবং মুহূর্তে সেটি ঘুরে প্রচণ্ড গতিতে ছুটে যেতে শুরু করে।