স্ক্যানিং? আমার মাথা ঘুরে ওঠে, কী বলছে ক্রুগো কম্পিউটার। মস্তিষ্ক স্ক্যানিং করবে মানে?
কিম জুরানের মস্তিস্ক স্ক্যানিং করার উদ্দেশ্য দু’টি। এক, তাঁর স্মৃতি থেকে আমরা যাবতীয় গোপন জিনিস জানতে পারব। বিজ্ঞানীরা রুকুন গ্রহপুঞ্জ সম্পর্কে মূল্যবান তথ্য পাবেন। দুই, তাঁর নিজের স্মৃতি পুরোপুরি অপসারণ করা হবে বলে তাঁর জীবনের দুঃখজনক ইতিহাসকে পুরোপুরি ভুলে গিয়ে নূতন জীবন শুরু করতে পারবেন।
আমি অনেক কষ্টে নিজেকে শান্ত করে রেখেছিলাম, আর পারলাম না, একেবারে বোমার মতো ফেটে পড়লাম, এর চেয়ে আমাকে মেরে ফেল না কেন? আমার পুরো স্মৃতি যদি ধ্বংস করে দাও, তাহলে আমার আর এই চেয়ারটার মাঝে পার্থক্য কী? আমাকে মুক্তি দিয়ে তাহলে কি লাভ? আমি কি শুধু হাত-পা আর শরীর?
আপনি অযথা উত্তেজিত হচ্ছেন কিম জুরান, ক্রুগো কম্পিউটার শান্ত স্বরে বলল, আপনার ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দের উপর ভিত্তি করে সিদ্ধান্ত নেয়া হয় না। সমাজের ভালমন্দের প্রতি আমাদের একটা দায়িত্ব আছে।
আমি রাগে আত্মহারা হয়ে বললাম, চুপ কর বেটা বদমাইশ। জোচ্চোর কোথাকার–
নীষা আমার উপর ঝুঁকে পড়ে, আমি আমার হাতে সিরিঞ্জের একটা খোঁচা অনুভব করলাম, সাথে সাথে হঠাৎ চোখের উপর অন্ধকার নেমে আসে। জ্ঞান হারানোর পূর্বমুহূর্তে নীষার চোখের দিকে তাকালাম, শান্ত চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে, চোখ দুটিতে আতঙ্ক নয়, কৌতুক।
০৭. দ্বিতীয় জীবন
৭. দ্বিতীয় জীবন
জ্ঞান হবার পর আমি নিজেকে আবিষ্কার করলাম একটা উচু আসনের উপর। আমি শুয়ে আছি এবং আমাকে ঘিরে অনেক ক’জন সাদা পোশাকের ডাক্তার ব্যস্ত হয়ে ঘোরাফেরা করছে। আমি নীষাকেও একপাশে দেখলাম, জটিল একটা যন্ত্রের সামনে গম্ভীর মুখে বসে আছে, আমার চোখে চোখ পড়তেই মুহূর্তের জন্যে তার মুখে একটু হাসি ফুটে ওঠে। আমি মাথা ঘুরিয়ে অন্য পাশে তাকানোর চেষ্টা করতে গিয়ে বুঝতে পারলাম আমার মাথায় অসংখ্য মনিটর লাগানো। কয়েকটা সম্ভবত কপালের চামড়া ফুটো করে ঢোকানো হয়েছে, বেশ জ্বালা করছে সেগুলো।
আমি দীর্ঘ সময় চুপচাপ শুয়ে রইলাম, কেউ আমার সাথে কোনো কথা বলছে, আমি নিজেও কোনো কথা বলার চেষ্টা করলাম না। আমি এরকম অবস্থায় চুপচাপ শুয়ে থাকার পাত্র নই, কিন্তু কোনো-একটা কারণে আমি এখন কোনোকিছুতেই উৎসাহ পাচ্ছিলাম না। সম্ভবত আমাকে কোনো ওষুধ দিয়ে এরকম নির্জীব করে রাখা হয়েছে। আমি শুয়ে শুয়ে মস্তিষ্ক স্ক্যানিং-এর জন্য অপেক্ষা করতে থাকি। ব্যাপারটি সহজ নয়, ঠিক কীভাবে করা হয় আমার জানা নেই। মস্তিষ্কের নিউরোন সেল থেকে স্মৃতিকে সরিয়ে ম্যাগনেটিক ডিস্কে ডিজিটাল সিগনাল হিসেবে জমা করা হয়। পদ্ধতিটা সুচারুভাবে করার জন্যে যে পদ্ধতিটা ব্যবহার করা হয় সেটি মস্তিষ্কের স্মৃতিকে পুরোপুরি ধ্বংস করে দেয়। কিছুক্ষণের মাঝেই আমার সমস্ত স্মৃতি ধ্বংস হয়ে যাবে চিন্তা করে যতটুকু দুঃখ পাওয়া উচিত, কোনো কারণে আমার ঠিক সেরকম দুঃখ হচ্ছিল না। সেটি ওষুধের প্রভাবে, না, নীষার উপর আমার প্রবল বিশ্বাসের জন্য আমি ঠিক বুঝতে পারছিলাম না।
মস্তিষ্ক স্ক্যানিং-এর ব্যাপারটা শুরু হওয়ার আগে আমি বুঝতে পারি, হঠাৎ করে কথা শোনা যেতে লাগল। আশ্চর্য ব্যাপার যে কথাগুলো কোনো শব্দ থেকে আসছিল না, সরাসরি আমার মস্তিষ্কে উচ্চারিত হচ্ছিল। অনেকটা চিন্তা করার মতো, কিন্তু অনুভূতিটা চিন্তা করার মতো মৃদু নয়, অনেক প্রবল।
হঠাৎ করে কেউ-একজন যান্ত্রিক স্বরে আমাকে উদ্দেশ করে কথা বলে ওঠে। কোনো শব্দ নেই, কিন্তু তবু আমাকে কিছু-একটা বলা হচ্ছে; অনুভূতিটা আশ্চর্য, আমার অকারণেই গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে! আমাকে বলা হল, কিম জুরান, আপনার মস্তিষ্ক স্ক্যানিং শুরু হচ্ছে। পদ্ধতিটা যন্ত্রণাবিহীন কিন্তু একটু সময়সাপেক্ষ। পুরোপুরি শেষ হতে প্রায় দুই ঘন্টা সময় নেবে। মস্তিষ্ক স্ক্যানিং শেষ হওয়ার পর আপনি একজন নুতন মানুষে পরিণত হবেন। আপনাকে একটি নতুন পরিচয় দেয়া হবে, আপনার মধ্যে একটি নতুন ব্যক্তিত্বের জন্ম হবে। এখন চোখ বন্ধ করে আপনি আপনার সমস্ত অনুভূতি শিথিল করে শুয়ে থাকুন। ধন্যবাদ।
আমি অসহায়ভাবে শরীর শিথিল করে শুয়ে থাকি। কতক্ষণ কেটেছে জানি না, হঠাৎ আমি চমকে উঠি, আমার শৈশবের একটা স্মৃতি ভেসে আসছে, আমার মা, যাঁর চেহারা আমি ভুলে গিয়েছিলাম, তাঁকে আমি দেখতে পাই। তিনি জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছেন, আমি তাঁর কোলে। বাইরে ঝমঝম শব্দে বৃষ্টি হচ্ছে, আমার মা আশ্চর্য একটা বিষণ্ণ সুরে গান গাইছেন আমাকে ঘুম পাড়ানোর জন্যে। হঠাৎ করে আমার মা, বৃষ্টির শব্দ, গানের সুর—সবকিছু মিলিয়ে গেল, কিছুক্ষণ আমার স্মৃতিতে কিছু নেই। খানিকক্ষণ পর সেখানে নূতন একটা দৃশ্য ফুটে ওঠে। আমি দেখতে পেলাম সবুজ ঘাসের উপর দিয়ে আমি ছোট ছোট পা ফেলে ছুটে যাচ্ছি। আমার হাতে একটা লাল রুমাল, আমি চিৎকার করে বলছি, লাল ঘোড়া ঠকাঠক, লাল ঘোড়া ঠকাঠক, লাল ঘোড়া ঠকাঠক—দেখতে দেখতে এই পুরো দৃশ্যটাও অদৃশ্য হয়ে গেল।
কতক্ষণ এভাবে কেটেছে জানি না, এক মিনিটও হতে পারে, আবার এক ঘন্টাও হতে পারে। আমি আচ্ছন্নের মতো শুয়ে শুয়ে আমার শৈশবের ভুলে যাওয়া দৃশ্যগুলো দেখতে দেখতে এক ধরনের ব্যথা অনুভব করতে থাকি। দৃশ্যগুলো একবার মিলিয়ে যাবার পর আর কিছুতেই সেগুলো মনে করতে পারছিলাম না, আমার মস্তিষ্ক থেকে সরে গিয়ে সেগুলো কোন–একটি ম্যাগনেটিক ডিস্কে স্থান নিয়েছে। ব্যাপারটি চিন্তা করে আমার কেমন জানি দুঃখবোধ জেগে ওঠে। ঠিক তখনই একটা আশ্চর্য ব্যাপার ঘটল, আমার মস্তিষ্কের ভেতর নীযা কথা বলে উঠল। কোনো শব্দ হল না, কিন্তু আমি শুনতে পেলাম নীষা বলল, কিম জুরান, আপনি যেভাবে শুয়ে আছেন ঠিক সেভাবে শুয়ে থাকুন, মুখের মাংসপেশী পর্যন্ত নাড়াবেন না, কেউ যেন বুঝতে না পারে আপনি আমার কথা শুনছেন। আপনার হৃৎস্পন্দন বেড়ে যাচ্ছে, সেটাকে স্বাভাবিক করতে হবে, এ ছাড়া ডাক্তারদের সন্দেহ হতে পারে।