ক্রুগো কম্পিউটার এক মুহূর্ত অপেক্ষা করে বলল, আপনাকে অনুরোধ করা হচ্ছে যে, আপনাকে ঠিক যা জিজ্ঞেস করা হবে তার উত্তর দেবেন। এই কমিশন অবান্তর আলোচনায় উৎসাহী নয়।
তোমার তাই ধারণা? যারা হাজির আছে জিজ্ঞেস করে দেখ তোমার কচকচি শুনতে কারো মাথাব্যথা আছে কী না।
ক্রুগো কম্পিউটার আমাকে পুরোপুরি উপেক্ষা করে বলল, আপনাকে মৃত্যুদণ্ডের পরিবর্তে রুকুন গ্রহপূঞ্জে পাঠাননা হয়েছিল, সেখানে থেকে সুস্থ অবস্থায় ফিরে এলেন কেমন করে?
তুমি না এত বড় কম্পিউটার, সারা পৃথিবীতে এত নামডাক, তুমিই বল। মহাকাশযানের কম্পিউটারকে জিজ্ঞেস করে দেখ, তার সব জানার কথা।
আপনাকে যা জিজ্ঞেস করা হয়েছে তার উত্তর দিন। আপনি সুস্থ অবস্থায় কীভাবে ফিরে এলেন?
আমি উচ্চস্বরে একবার হাসার মতো শব্দ করে বললাম, বলতে লজ্জা হচ্ছে নাকি যে তোমার এত সাধের কম্পিউটার পুরোপুরি ধসে গিয়েছিল? মহাকাশযানের কম্পিউটারের পুরো মেমোরি কিভাবে লোপাট হয়েছিল, কমিশনকে বোঝাও দেখি!
বিজ্ঞানীদের ভেতর খানিকটা উত্তেজনা দেখা গেল, কিন্তু গো কম্পিউটার প্রশ্ন করা শেষ করার আগে তাদের কথা বলার অধিকার নেই।
মহাকাশযানের কম্পিউটারের মেমমারি কীভাবে মুছে গিয়েছে আপনি কি জানেন?
আমাকে ঘুম পাড়িয়ে পাঠানো হয়েছিল, তুমি কি আশা কর আমি স্বপ্নে সব খবরাখবর পাব?
চারজন উচ্চপদস্থ লোকের একজনের কাছে একটা হাতুড়ি আছে খেয়াল করি নি, সে সেটা দিয়ে টেবিলে দু বার শব্দ করে রাগী গলায় বলল, আপনি যদি সহযোগিতা করেন এই কমিশন বন্ধ করে দেয়া হবে, সেটি আপনার ভবিষ্যতের জন্য আশাপ্রদ নাও হতে পারে।
আমাকে ভয় দেখাচ্ছে। নীষা আমাকে বলেছে আমি যা খুশি বলতে পারি, আমাকে কী করা হবে সেটা আগেই ঠিক করে রাখা হয়েছে, কাজেই আমার ভয় পাবার নূতন কিছু নেই। কিন্তু কমিশন বন্ধ করে দেয়া হোক সেটা আমার ইচ্ছে নয়, বিজ্ঞানীদের সাথে আমি একটু কথা বলতে চাই।
বললাম, বেশ, সহযোগিতা করব, কিন্তু অবান্তর প্রশ্ন করে লাভ নেই, উত্তর পাবেন না।
ক্রুগো কম্পিউটার এবারে সম্পূর্ণ অন্য জিনিস জিজ্ঞেস করতে শুরু করে, আপনার এত আত্মবিশ্বাস কোথা থেকে এসেছে?
আমি থতমত খেয়ে বললাম, কিসের আত্মবিশ্বাস? আপনি জানেন আপনার আর কোনো ভয় নেই, সেটি কোথা থেকে এসেছে?
আমি আড়চোখে নীষার দিকে তাকালাম, সেও চোখ সুরু করে আমার দিকে তাকিয়ে আছে, যেন আমি কী উত্তর দিই সেটি তার জানার খুবই প্রয়োজন।
আমি মুখ শক্ত করে বললাম, আমাকে মৃত্যুদণ্ডের শাস্তি হিসেবে রুকুন গ্ৰহপুঞ্জে পাঠানো হয়েছিল, আমি সেখান থেকে ফিরে এসেছি, আমার শাস্তি ভোগ করেছি, এখন আমাকে তোমাদের মুক্তি দিতেই হবে। আমি এখন আর আসামী নই, আমি স্বাধীন মানুষ।
রুকুন গ্রহ থেকে আপনি সুস্থ অবস্থায় ফিরে এসেছেন, এর আগে কেউ আসে নি। কাজেই যতক্ষণ আমরা জানতে না পারছি কীভাবে আপনি সুস্থ অবস্থায় ফিরে এসেছেন, ততক্ষণ আপনাকে পৃথিবীর নিরাপত্তার খাতিরে অন্তরীণ করে রাখার প্রয়োজনীয়তা আছে।
আমি অনুভব করতে পারি ধীরে ধীরে আমার ভেতরে ক্রোধের জন্ম হচ্ছে। অনেক কষ্টে নিজেকে শান্ত করে বললাম, কম্পিউটারকে যেদিন মিথ্যা কথা বলা শেখানো হয়েছে, সেদিনই এই পৃথিবীকে খরচের খাতায় লেখা হয়ে গেছে।
আপনি কী বলতে চাইছেন?
আমি বলতে চাইছি তুমি একটা মিথ্যাবাদী ভণ্ড প্রতারক।
আপনি কেন আমাকে মিথ্যাবাদী ভণ্ড এবং প্রতারক বলে দাবি করছেন?
কারণ আমাকে অন্তরীণ করে রাখার একটামাত্র কারণ, আমি যেন বাইরের পৃথিবীকে বলতে না পারি আমাকে কীভাবে প্রতারণা করে একটা মহাকাশযানে পাঠানো হয়েছিল–
হঠাৎ নীষা আমার হাত চেপে ধরে, আমি থামতেই সে ঘুরে অন্যদের দিকে তাকিয়ে বলল, কিম জুরানের রক্তচাপ হঠাৎ করে বেড়ে গিয়েছে, তাঁর বর্তমান অবস্থায় এটি অত্যন্ত ক্ষতিকর। আমি আপাতত এই কমিশন বন্ধ করে দেয়ার অনুরোধ করছি।
ক্রুগো কম্পিউটার শান্ত গলায় বলল, কমিশন সমাপ্ত হয়েছে। আমার আর কিছু প্রশ্ন করার নেই, আমার যা জানার ছিল তা জেনে নিয়েছি।
একজন বিজ্ঞানী হাত তুলে বলল, আমাদের কিছু জিনিস জিজ্ঞেস করার ছিল।
নীষা মাথা নেড়ে বলল, আজ আর সম্ভব নয়।
হাতুড়ি হাতে উচ্চপদস্থ কর্মচারীটি বলল, তাহলে এখন কি কমিশনের সিদ্ধান্ত জানতে পারি?
হ্যাঁ। ক্রুগো কম্পিউটার একঘেয়ে গলায় বলল, কিম জুরানকে মৃত্যুদণ্ডের শাস্তি হিসেবে রুকুন গ্ৰহপুঞ্জে পাঠানো হয়েছিল, তিনি সেই শাস্তি ভোগ করে এসেছেন, কাজেই তাঁকে মুক্তি দেয়া হল।
আমি নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পরলাম না, আনন্দে চিৎকার করতে গিয়ে থেমে নীষার দিকে তাকালাম। নীষা গম্ভীর মুখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে, তার মুখে হাসি নেই। জিজ্ঞেস করলাম, কী হল?
পুরোটা শুনুন আগে।
ক্রুগো কম্পিউটার আবার শুরু করে, কিম জুরান এই কমিশনে সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করেছেন যে, তিনি এই মহাকাশ অভিযানের অনেক তথ্য জানেন, যা আমাদের সাথে আলোচনা করতে অনিচ্ছুক। তাঁর অস্বাভাবিক আত্মবিশ্বাসের প্রধান কারণ সম্ভবত কোনো-এক ষড়যন্ত্রী দলের সাথে যোগাযোগ। আপাতত সেই ষড়যন্ত্ৰী দলকে আমি রবোট্রনের কোনো-এক দল হিসেবে সন্দেহ করছি। এইসব কারণে আমাদের কিম জুরানের পুরো স্মৃতিটুকু জানা প্রয়োজন। আমি তাঁর মস্তিষ্ক স্ক্যানিং করে পুরো স্মৃতিটুকু সরিয়ে নেয়ার সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হলাম।