কি?
এক নম্বর বিষয় হচ্ছে, আপনার নিজের নিরাপত্তা। আপনাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছিল, তার শাস্তি হিসেবে আপনি রুকুন গ্রহপুঞ্জ থেকে ঘুরে এসেছেন, আইনত এখন আপনাকে মুক্তি দিতে বাধ্য। তাই আপনি মুক্তি পাবেন। কী অবস্থায় পাবেন সেটি হচ্ছে কথা। বেশিকিছু আশা করবেন না আগেই বলে রাখছি। নীষা একটু হাসার ভঙ্গি করল।
কর্তৃপক্ষের কাছে আপনি যা ইচ্ছা বলতে পারেন, কিছুই আসে যায় না। কারণ, আপনাকে কী করা হবে সেটি আপনি ফিরে আসামাত্রই ঠিক করা হয়ে গেছে।
কী করা হবে?
সময় হলেই জানবেন। নীষা আমার প্রশ্নটি এড়িয়ে গম্ভীর গলায় বলল, আপনি কর্তৃপক্ষের কাছে যা ইচ্ছে বলতে পারেন, শুধুমাত্র দু’টি ব্যাপার ছাড়া। এক, মহাকাশযানে আপনার সাথে লুকাসের যোগাযোগ হয়েছিল। দুই, আমি লুকাসকে অনুরোধ করেছিলাম আপনাকে রক্ষা করতে। এটি জরুরি, আমার নিজের নিরাপত্তার জন্য।
আমাকে দিয়ে জোর করে কিছু বলানোর চেষ্টা করবে না?
আপাতত নয়। প্রথমে আপনাকে নিয়ে আবার একটা বিচারের প্রহসন হবে।
আবার?
হ্যাঁ। কিম জুরান, আমাদের নিরিবিলি কথা বলার সময় পার হয়ে যাচ্ছে, মনে রাখবেন আমি কী বললাম।
রাখব। একটু থেমে বললাম, নীষা।
কি?
তুমি আমাকে বাঁচালে কেন?
যে যান্ত্রিক গুঞ্জনটা এতক্ষণ আমাদের কথাবার্তাকে আড়াল করে রেখেছিল, সেটা হঠাৎ থেমে যায়। নীষা তাই কথা না বলে আমার চোখের দিকে তাকিয়ে হাসে। আমার বুকের ভেতর নড়েচড়ে যায় হঠাৎ, একজন মানবী, কী আশ্চর্য একটা অভিজ্ঞতা।
নীষা চোখের সামনে থেকে সরে যায়, আমি তার গলার স্বর শুনতে পাই, কাকে যেন বলল, কিম জুরানের জ্ঞান ফিরে এসেছে।
সাথে সাথে কার যেন উত্তেজিত গলার স্বর শুনতে পেলাম, এসেছে?
হ্যাঁ।
কখন?
এইমাত্র।
আমি আসছি।
আসতে পারেন, কিন্তু এখন তার সাথে কথা বলতে পারবেন না।
কেন?
নীষা অসহিষ্ণু স্বরে বলল, এই মানুষটি এক বছরের মতো সময় একটা ছোট ক্যাপসুলে ঘুমিয়ে ছিলেন। যখন তাকে উদ্ধার করা হয়েছে তখন তাঁর তাপমাত্রা অ্যাবসলিউট শূন্যের কাছাকাছি, কতদিন থেকে কেউ জানে না। তাঁকে পুরোপুরি পরীক্ষা না করে আমি কারো সাথে কথা বলতে দেব না।
লোকটি বলল, তুমি নিশ্চয়ই জান, কিম জুরান মৃত্যুদণ্ডের আসামী?
আসামী ছিলেন। তাঁকে যে-শাস্তি দেয়া হয়েছিল তিনি সেটা ভোগ করে এসেছেন, এখন তিনি আর কোনোকিছুর আসামী নন।
সেটা বিচারকের সিদ্ধান্ত, তাঁরা ঠিক করবেন। আমি বিচারক নই, আমি জানি না।
আমিও বিচারক নই, কিন্তু আমি জানি।
লোকটি একটু থেমে বলল, তুমি দেখছি কিম জুরানের প্রাণ বাঁচাতে খুব ব্যস্ত!
হ্যাঁ, আমি ডাক্তার। আমি সারাজীবন মানুষকে বাঁচানোর চেষ্টা করে এসেছি, আপনার কাছে খুব অস্বাভাবিক লাগতে পারে, কিন্তু এটাই আমার কাজ।
নীষা সুইচ টিপে কী-একটা বন্ধ করে আমার কাছে এগিয়ে এসে বলল, আপনাকে একটা ইনজেকশান দিয়ে দিচ্ছি, আপনি একটু ঘুমান। হাতে সিরিঞ্জ নিয়ে নীষা ঝুঁকে পড়ে আমার দিকে তাকায়, তারপর হঠাৎ আলতোভাবে আমার কপালে ঠোট স্পর্শ করে। আহা, কতকাল পরে আমাকে একজন রক্তমাংসের মানুষ স্পর্শ করল।
আমার হঠাৎ একটা আশ্চর্য জিনিস মনে হল, নীষা কি মানুষ, নাকি একটা রবোট্রন?
আমি তাকে জিজ্ঞেস করতে পারলাম না, হাতে সুচের স্পর্শ পেয়ে গাঢ় ঘুমে ঢলে পড়লাম মুহূর্তে।
আমি একটা হুইল চেয়ারে বসে আছি। চেষ্টা করলে আমি আস্তে আস্তে হাঁটতে পারি, কিন্তু তবুও এখন বেশিরভাগ সময়েই হুইল চেয়ারে চলাফেরা করছি। ধীরে ধীরে আমার হাতে-পায়ে বল ফিরে আসছে, দীর্ঘদিন ব্যবহার না করায় শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ আশ্চর্য শক্তিহীন হয়ে পড়েছিল। আমার পাশে বসে আছে নীষা, আশেপাশে আরো অনেক লোকজন, তাই আমার প্রতি তার আচার-আচরণ হিসেব করা। আমার ডাক্তার হিসেবে নীষা এই কমিশনে আসতে পেরেছে, স্বাভাবিক অবস্থায় তার এখানে থাকার কথা নয়। বড় ঘরের অন্য পাশে কালো টেবিলে চারজন লোক বসে আছে, অত্যন্ত উচ্চপদস্থ লোক এরা, দেখেই বোঝা যায়। অসুখী মানুষের মতো রাগী রাগী চেহারা। চুপচাপ বসে আছে, নিজেদের ভেতরেও কথা বলছে না। ডান পাশে একটা কালো টেবিলে বসে আছে বিজ্ঞানীরা, এদের দেখেও বোঝা যায় এরা বিজ্ঞানী। সবাই উশখুশ করছে, একজন আরেকজনের সাথে কথা বলছে, কাগজে কিছু লিখছে, চাপা স্বরে হাসছে। বসে থেকে থেকে আমি অধৈর্য হয়ে পাশে বসে থাকা নীষাকে বললাম, আর কতক্ষণ?
এই তো শুরু হল বলে।
অপেক্ষা করছি কী জন্যে?
ক্রুগো কম্পিউটারের জন্যে। প্রোগ্রাম লোড করছে। কোনটা লোড করে কে জানে, ম্যাগমা ফোর না করলেই হয়।
কেন, ম্যাগমা ফোর হলে কী হবে?
হবে না কিছুই, ম্যাগমা ফোর একটু কাঠখোট্টা ধরনের, রসবোধ কম।
আমি নীষার দিকে ঘুরে তাকালাম, এই পরিবেশেও সে একটি রসবোধসম্পন্ন কম্পিউটার প্রোগ্রাম আশা করছে!
আমি কি-একটা কথা বলতে যাচ্ছিলাম, ঠিক তক্ষুণি ক্রুগো কম্পিউটারের গলার স্বর শোনা গেল। একঘেয়ে গলার স্বরে এই কমিশনের নিয়ম-কানুন, উপস্থিত সদস্যদের পরিচয় ইত্যাদি শেষ করে আমাকে প্রশ্ন করা শুরু করে।
আপনি কি অস্বীকার করতে পারেন যে আপনাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছিল?
না, আমি মাথা নেড়ে বললাম, দেয়া যেতে পারে কি না সেটা নিয়ে তর্ক করতে পারি, কিন্তু দেয়া হয়েছিল কী না জিজ্ঞেস করলে অস্বীকার করতে পারব না।