হয়তো হয়।
তুমি আমাদের জান গ্ৰহপুঞ্জ হিসেবে। আমাদের নাম দিয়েছ রুকুন গ্রহপুঞ্জ। ভারি আশ্চর্য! সবকিছুর তোমরা একটা নাম দাও। সবকিছুর একটা নাম, নাহয় একটা সংখ্যা! রুকুন-রুকুন-রুকুন! ভারি আশ্চর্য নাম! আমাদের সম্পর্কে আর কিছু তুমি জান না। কীভাবে জানবে, তুমি তো এখানে থাক না। আমরা কয়েক লক্ষ মাইল জুড়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছি। তুমি অণু দিয়ে তৈরী, তোমার অণুগুলো বিদ্যুৎ চৌম্বকীয় শক্তি দিয়ে আটকে আছে। আমরাও অণু দিয়ে তৈরী, আমাদের অণুগুলোও বৈদ্যুতিক চৌম্বকীয় শক্তি দিয়ে আটকে আছে, কিন্তু সেটা বাইরের ব্যাপার। তোমরা যেটাকে উইক ফোর্স বল সেটা হচ্ছে আমাদের সত্যিকার অস্তিত্ব। তাই আমরা এত বড়, তাই আমরা এত জায়গা জুড়ে থাকি। আমাদের শক্তিও তাই সীমিত। উইক ফোর্সের শক্তি তে বিদ্যুৎ চৌম্বকীয় শক্তি থেকে কম হবেই! কিন্তু আকারে আমরা অনেক বড়, তাই সেটা আমরা পুষিয়ে নিতে পারি। উইক ফোর্স ব্যবহার করি বলে আমরা তোমার ভেতর পর্যন্ত খুলে দেখতে পারি। নিউট্রিনো পাঠিয়ে করি কিনা! নিউট্রিনো তো জান যেখানে খুশি যেতে পারে, অবশ্যি অনেকগুলো করে পাঠাতে হয়, কিন্তু সে আর সমস্যা কি? কী হল, তোমার কৌতূহল কমে আসছে?
জানি না।
তা অবশ্যি জানার কথা না। সবাই কি সবকিছু জানে? এবারে দেখি আর কী কী আছে। মস্তিষ্কের কাছাকাছি এই দুটি জিনিস দিয়ে তুমি দেখ। দেখা আরেকটা মজার ব্যাপার, তোমার দেখতে হয়, না দেখলে তুমি বলতে পার না জিনিসটা কেমন! আমি যদি তোমার দেখাটা বন্ধ করে দিই? এমন ব্যবস্থা করে দিই যে তুমি আর দেখবে না, কিংবা আরো মজা হয় যে দেখবে, কিন্তু অন্যরকম দেখবে! তুমি যেটাকে চোখ বল, সেটাতে যে-রেটিনা আছে সেটাকে আলট্রা ভায়োলেট আলোতে সচেতন করে দিই? তাহলে স্বাভাবিক জিনিস তুমি আর দেখবে না কিন্তু কত অস্বাভাবিক জিনিস দেখা শুরু করবে! চোখ দুটি এক জায়গায় না রেখে দু’টি দু’ জায়গায় বসিয়ে দিলে কেমন হয়? দেব?
আবার থেমে যায় সে। আর সেই মুহূর্তে একটা আশ্চর্য ব্যাপার ঘটতে থাকে। ঘুমের মাঝে আমি অনুভব করি কিছু একটা হচ্ছে। আমার স্বপ্ন, দুঃস্বপ্ন, অস্তিত্ব আস্তে আস্তে মিলিয়ে যাচ্ছে। আমি যেন আস্তে আস্তে অন্ধকারে তলিয়ে যাচ্ছি, আমার অনুভূতি যেন ধীরে ধীরে মিলিয়ে যাচ্ছে। আমার অস্তিত্ব তিলতিল করে বিলীন হয়ে যাচ্ছে।
বহুদূর থেকে আমি কারো আর্তচিৎকার শুনতে পাই, চিৎকার করে বলছে, কী হচ্ছে? কী হচ্ছে? তোমার জৈবিক সত্তা শেষ হয়ে যাচ্ছে? কেন শেষ হয়ে যাচ্ছে? তুমি শীতল হতে হতে জড় পদার্থে পরিণত হয়ে যাচ্ছ! জড় পদার্থ? তুচ্ছ জড় পদার্থ! প্রাণহীন অনুভূতিহীন জড় পদার্থ? জড় পদার্থ…
ধীরে ধীরে অন্ধকারে তলিয়ে যেতে যেতে আমি অনুভব করি আমার ভেতরে সজ্ঞানে-অজ্ঞানে সবসময়ে যে জেগে থাকত সে হারিয়ে যাচ্ছে। অনুভূতির ভেতরে যে অনুভূতি, অস্তিত্বের ভেতরে যে অস্তিত্ব, আমার ভেতরে যে আমি, তারা আর নেই। যেঅস্তিত্ব স্বপ্ন দেখে, দুঃস্বপ্ন দেখে, আতঙ্ক নিয়ে বিভীষিকার জন্যে অপেক্ষা করে, সেই অস্তিত্ব লোপ পেয়ে যাচ্ছে। আমার অস্তিত্ব যখন নেই, তখন এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডেরও কিছু নেই, কোথাও কিছু নেই। শূন্যতা—সে এক আশ্চর্য শূন্যতা, তার কোনো বর্ণনা নেই।
এটিই কী মৃত্যু? এই মৃত্যুকে আমি এতকাল ভয় পেয়ে এসেছি?
০৬. নীষা
৬. নীষা
আমি চোখ খুলে তাকালাম। ধবধবে সাদা একটা ঘরে আমি শুয়ে আছি। এটা কি স্বপ্ন? আমি চোখ বন্ধ করে আবার খুলি, না, এটা স্বপ্ন না, সত্যি আমি সাদা একটা ঘরে শুয়ে আছি, আমার শরীর চাদর দিয়ে ঢাকা। ঘরে কোনো শব্দ নেই, খুব কান পেতে থাকলে মৃদু একটা গুঞ্জন শোনা যায়, আমার ডান দিক থেকে আসছে শব্দটা। কিসের শব্দ এটা? মাথা ঘুরিয়ে দেখতে চাইলাম আমি, সাথে সাথে কোথায় জানি অসহ্য যন্ত্রণা করে ওঠে। ছোট্ট একটা আর্তনাদ করে আমি চোখ বন্ধ করে ফেললাম, চোখের সামনে হলদে আলো খেলা করতে থাকে, দাঁতে দাঁত চেপে যন্ত্রণাটাকে কমে আসতে দিয়ে আবার সাবধানে চোখ খুলি আমি। আমার উপর ঝুঁকে তাকিয়ে আছে একটি মেয়ে, কী সুন্দর মেয়েটি! আমাকে তাকাতে দেখে মেয়েটি মিষ্টি করে হাসে আর হঠাৎ আমি তাকে চিনতে পারি–নীষা।
হ্যাঁ, আমি নীষা। পৃথিবীতে আপনাকে অভ্যর্থনা জানাচ্ছি কিম জুরান!
আমি পৃথিবীতে। কী হয়েছিল আমার?
আপনি মহাকাশযানে করে ফিরে এসেছেন, ক্যাপসুলের ভেতরে আপনার তাপমাত্রা ছিল শূন্যের নিচে দুই শত বাহাত্তর দশমিক আট ডিগ্রী।
সত্যি?
হ্যাঁ।
কেমন করে হল?
জানি না। মেয়েটি মিষ্টি করে হাসে, কেউ জানে না। মহাকাশযানের যে কম্পিউটার ছিল সেটির মেমোরি পুরোটা কীভাবে জানি উধাও হয়ে গেছে। কেউএকজন যেন ঝেড়ে-পুছে নিয়ে গেছে।
লুকাস! আমার মুখে হাসি ফুটে ওঠে, নিশ্চয়ই লুকাস!
মেয়েটি এবারে আমার উপরে আরো ঝুঁকে আসে, আমি তার শরীরের মিষ্টি গন্ধ পাই। মেয়েটি চোখ বড় বড় করে বলল, আপনাকে কয়েকটা জিনিস বলে দিই, আর কখনো সুযোগ পাব না। আপনার জ্ঞান ফিরে আসছিল বলে আমি প্রাজমো কিটোগ্রাফটা চালু করেছি, এটা চালু থাকলে এই ঘরের শব্দ বাইরে যেতে পারে না, আমরা তাই নিরিবিলি কথা বলতে পারব। বেশিক্ষণ নয়, তাই এখনই বলে দিচ্ছি, খুব জরুরি কয়েকটা কথা।