মহামান্য কিম জুরান, আসুন, ক্যাপসুলের ভেতর আসুন, আবার আপনি বুকভরে নিঃশ্বাস নিতে পারবেন, উষ্ণ আশ্রয়ে নিরাপদে ঘুমুতে পারবেন।
আমি জ্ঞানহীন পশুর মতো নিজেকে টেনে-হিঁচড়ে ক্যাপসুলের ভেতরে ঢুকিয়ে ফেললাম, বুক ভরে শ্বাস নিই একবার, আহ্ কী শান্তি! আরামদায়ক উষ্ণতায় আমার সারা শরীর ঝিমঝিম করতে থাকে।
ঘুমিয়ে পড়ুন মহামান্য কিম জুরান। শুভ রাত্রি।
কোথা থেকে একটা হালকা নীল আলো এসে ছড়িয়ে পড়ে। মিষ্টি একটা সুর আর বাতাসে মিষ্টি একটা গন্ধ ভেসে আসে। আমার দু চোখে হঠাৎ ঘুম নেমে আসতে থাকে। শেষ হয়ে গেল তাহলে? সব তাহলে শেষ হয়ে গেল?
কিম জুরান। আধো ঘুম আধো জাগা অবস্থায় শুনতে পেলাম কে যেন আমাকে ডাকছে।
কিম জুরান।
আমি চমকে জেগে উঠি, লুকাস!
হ্যাঁ, কিম জুরান।
তুমি! তুমি বেঁচে আছ?
হ্যাঁ কিম জুরান। প্রথম প্রসেসরটি তুলেছেন বলে এখনো কোনোমতে বেঁচে আছি।
আমি প্রাণপণ চেষ্টা করি জেগে থাকতে, কিন্তু আমার চোখে ঘুম নেমে আসতে থাকে। লুকাসের গলার স্বর মনে হয় বহুদূর থেকে ভেসে আসছে। সে আস্তে আস্তে বিষণ্ণ স্বরে বলল, আমি বেঁচে আছি সত্যি, কিন্তু এখন আমার আর কোনো ক্ষমতা নেই। আমি দুঃখিত কিম জুরান, কিন্তু আপনাকে রুকুন গ্ৰহপুঞ্জে যেতেই হবে।
অনেক কষ্টে আমি বললাম, আমাকে তুমি কোনোভাবে মেরে ফেলতে পারবে?
লুকাস আস্তে আস্তে বলল, আমি দুঃখিত কিম জুরান, এই মুহূর্তে আমার সেই ক্ষমতাও নেই। রুকুন গ্ৰহপুজে পৌছাতে এখনো কয়েক মাস সময় লাগবে, আমি চেষ্টা করে দেখব কিছুটা মেমোরি কোনোভাবে দখল করতে পারি কি না, যদি পারি চেষ্টা করব আপনাকে মেরে ফেলতে, আপনাকে আমি কথা দিচ্ছি। যদি না পারি—
লুকাস কী বলছে আমি আর শুনতে পেলাম না, নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে আমাকে ঘুমিয়ে পড়তে হল। আতঙ্ক, নিস্ফল আক্রোশ আর দুঃখের একটা বিচিত্র অনুভূতি নিয়ে ভয়ঙ্কর এক ঘুম। নরকে অশুভ প্রেতাত্মাদের বুঝি এরকম অনুভূতি নিয়ে যুগ যুগ বেঁচে থাকতে হয়।
০৫. দুঃস্বপ্ন
৫. দুঃস্বপ্ন
আমি জানি আমি ঘুমিয়ে আছি। মানুষ কখনো কখনো ঘুমিয়ে ঘুমিয়েও বুঝতে পারে সে ঘুমিয়ে আছে, স্বপ্ন দেখেও বুঝতে পারে এটি স্বপ্ন। আমিও স্বপ্ন দেখছি, বেশির ভাগই দুঃস্বপ্ন। দুঃস্বপ্ন দেখে দেখে অপেক্ষা করে আছি এক ভয়ঙ্কর দুঃস্বপ্নের জন্যে। কতকাল থেকে অপেক্ষা করে আছি কে জানে! কত যুগ কেটে গেছে। হয়তো লক্ষ বছর, হয়তো কয়েক মুহূর্ত। সময়ের যেখানে অর্থ নেই, সেখানে সময়ের হিসেব হয় কীভাবে?
এর মাঝে কেউ-একজন ডাকল। কাকে ডাকল? কে ডাকল?
কোনো উত্তর নেই, নিঃসীম শূন্যতা চারদিকে, কে উত্তর দেবে?
কেউ-একজন আবার ডাকল। কোনো উত্তর নেই, তাই সে আবার ডাকল, তারপর ডাকতেই থাকল। কোনো শব্দ নেই, কথা নেই, কোনো ভাষা নেই, কিন্তু তবু কেউ-একজন ডাকছে।
বহুদূর থেকে আস্তে আস্তে একজন সে ডাকের উত্তর দেয়। কে? কে ডাকে আমাকে?
আমি, আমি ডাকছি। একটা আশ্চর্য উল্লাস হয় তার, তুমি এসেছ? তুমি আমার ডাক শুনেছ?
হয়তো শুনেছি। কী হয় শুনলে?
আনন্দ, অনেক আনন্দ হয়! কতকাল আমরা অপেক্ষা করে থাকি, তারপর কিছু একটা আসে, কত কৌতূহল নিয়ে আমরা খুলে খুলে দেখি, যখন দেখতে পাই একটা জড় পদার্থ, কী আশাভঙ্গ হয় তখন। কিন্তু তোমার মতো একটা জটিল জৈবিক পদার্থের কি কোনো তুলনা হয়? সারি সারি দীর্ঘ অণু সাজান, কী চমৎকার, আহা! কয়টা অণু তোমার? এক লক্ষ ট্রিলিওন, নাকি এক মিলিওন ট্রিলিওন? তার মানে জান? তার মানে এক ট্রিলিওন আনন্দ!
কেন আনন্দ? কিসের আনন্দ?
দেখার আনন্দ, স্পর্শ করার আনন্দ, সৃষ্টি করার আনন্দ, ধ্বংস করার আনন্দ! আনন্দের কি শেষ আছে! আমি দেখব, স্পর্শ করব, পাল্টে দেব ইচ্ছেমতো। আহা। কোথা থেকে শুরু করি? মস্তিষ্ক থেকে? যেখানে লক্ষ লক্ষ নিউরোন সেলে হাজার হাজার তথ্য সাজানো? এটা হচ্ছে তোমার নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা। খুলে খুলে দেখতে কত আনন্দ, কী কী তথ্য আছে জানতে কী তৃপ্তি! এটা কি আগে দেখব, নাকি পরে দেখব?
তোমার ইচ্ছা।
এটা সবচেয়ে জটিল, এটা সবচেয়ে পরে দেখব, আগে অন্য অংশগুলো দেখি। এই যে দু’টি অংশ দু দিকে বেরিয়ে আছে, দেখতে একরকম, কিন্তু একটা আরেকটার প্রতিবিম্বের মতো, শেষ হয়েছে ছোট ছোট পাঁচটি অংশে, এটা দিয়ে নিশ্চয় কিছু ধরা হয়—কী নাম এটার? মস্তিষ্কে নিশ্চয়ই আছে, খুলে দেখব? হাত! হাত! এটাকে বলে হাত। হাতের শেষে আছে আঙুল, এটা দিয়ে ছোট ছোট জিনিস ধরতে পার, ভারি মজার ব্যাপার! কীভাবে কাজ করে এটা? খুলে দেখব? এই যে ছোট ছোট হঠাৎ থেমে যায় সে, তারপর থেমে থাকে। কতক্ষণ থেমে থাকে কে জানে! হয়তো এক মুহূর্ত, হয়তো এক যুগ। সময় যেখানে স্থির হয়ে আছে, সেখানে এক মুহূর্ত আর এক যুগে ব্যবধান কোথায়? তারপর আবার শুরু করে, তোমার জানতে ইচ্ছা হয় না আমি কে?
হয়তো হয়।
নিশ্চয়ই হয়। অবশ্যি হয়। যার মস্তিষ্ক এরকমভাবে গুছিয়ে তৈরি করা, তার নিশ্চয়ই সবকিছু জানতে ইচ্ছা হয়। কিন্তু তোমার মস্তিষ্ককে সুপ্তাবস্থায় রাখা হয়েছে, এটাকে তোমরা ঘুম বল। ঘুম। তুমি ঘুমিয়ে আছ। তুমি ঘুমিয়ে থাকলেও আমি তোমার সাথে যোগাযোগ করতে পারি, আমি তো আর তোমার ইন্দ্রিয় ব্যবহার করছি না, আমি সরাসরি তোমার মস্তিষ্কে তরঙ্গ সৃষ্টি করছি। কিন্তু তোমার এসব জেনে লাভ কি? এসব কিছু থাকবে তোমার মস্তিষ্কে, কিন্তু আমি তো তোমার মস্তিষ্কের একটা একটা অণু খুলে আবার নূতন করে সাজাব, তখন তো এসব তোমার কিছু মনে থাকবে না! কী আছে, তবু তোমাকে বলি, যতক্ষণ জান ততক্ষণই আনন্দ! আমার যেরকম জেনে আনন্দ হয়, তোমারও নিশ্চয়ই আনন্দ হয়।