স্ক্রু দু’টি খুলে, আই.সি.র নিচে স্ক্রু ড্রাইভারটা ঢুকিয়ে হ্যাঁচকা টানে প্রসেসরটি তুলে ফেললাম, সাথে সাথে একটা আর্তচিৎকার করে কম্পিউটার থেমে গেল, ভিতরে হঠাৎ কবরের মতো নিস্তব্ধতা নেমে এল। পরপর নয়টি প্রসেসর তোলার কথা। আমি দ্বিতীয়টার দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলাম, এমন সময় লুকাসের গলার স্বর শুনতে পেলাম, চমৎকার, কিম জুরান৷ দেরি করবেন না, তুলে ফেলেন তাড়াতাড়ি।
তুমি! আমি ভেবেছিলাম, তুমি বলেছ যে তোমাকে কিছুক্ষণের জন্যে সরে পড়তে হবে!
সরে পড়ার কথা ছিল, কিন্তু আপনি প্রসেসরটা তুলে ফেলেছেন বলে আসতে পেরেছি।
চমৎকার!
হ্যাঁ, দেরি করবেন না।
আমি স্ক্রু ড্রাইভারটা তলায় দিয়ে প্রসেসরটা তুলতে যাব, লুকাস হঠাৎ ভয়পাওয়া গলায় বলল, দাঁড়ান।
কী হল?
কম্পিউটার সব প্রসেসর বদলে ফেলেছে।
মানে?
সব মেমোরি পেছনে সরিয়ে ফেলেছে, এগুলো তুলে এখন আর লাভ নেই।
তাহলে?
লুকাস উদ্বিগ্ন গলায় বলল, তাড়াতাড়ি পেছনে চলুন, পেছনের প্রসেসরগুলো তুলতে হবে।
আমি দ্বিধান্বিতভাবে বললাম, কিন্তু এগুলো তুলে ফেলি, ক্ষতি তো কিছু নেই।
লুকাস অধৈর্য গলায় বলল, ক্ষতি নেই, কিন্ত দেরি হয়ে যাচ্ছে। আমি বেশিক্ষণ থাকতে পারব না, এক্ষুণি সরে পড়তে হবে। তাড়াতাড়ি পেছনে চলুন, আপনাকে দেখিয়ে দিই কোনটা কোনটা তুলতে হবে।
আমি ভেসে ভেসে পেছনে সরে আসি। লুকাস আমাকে বলে দিতে থাকে আর আমি দেখে দেখে একটা একটা করে আই.সি. তুলে ফেলতে থাকি। সময় বেশি নেই, অনেকগুলো আই.সি, তুলতে বেশ সময় লেগে যাবে। লুকাস যদিও বলেছিল সে বেশিক্ষণ থাকতে পারবে না, কিন্তু শেষ পর্যন্ত সে আমার সাথে সাথে থেকে গেল, তাই আধ ঘন্টার মাঝেই আমি কাজ শেষ করে ফিরে আসতে পারলাম।
স্পেস স্যুট খুলে ঠিক জায়গায় রেখে আমি মাইক্রোফোনের কাছে এসে বললাম, লুকাস, আমার আর কিছু করার আছে?
লুকাস কী কারণে আমার কথার কোনো উত্তর দিল না। আমি একটু অবাক হয়ে বললাম, লুকাস, আমি এখন কী করব?
লুকাস তবু আমার কথার উত্তর দেয় না। আমি ভয় পেয়ে গলা উঁচিয়ে ডাকলাম, লুকাস।
কোনো সাড়া নেই। আমি এবার চিৎকার করে উঠি, লুকাস, তুমি কোথায়?
আমার গলার স্বর মহাকাশযানে প্রতিধ্বনিত হয়ে ফিরে এল, কিন্তু তবু লুকাস উত্তর দিল না। উত্তর দিল মূল কম্পিউটার, বলল, মহামান্য কিম জুরান, আপনাকে খুব দুঃখের সঙ্গে জানাচ্ছি, এখানে লুকাস আর নেই।
মানে?
লুকাস যে আই.সি.গুলোতে ছিল, আপনি একটু আগে তার সবগুলো তুলে ফেলেছেন।
আমি কিছু বলার আগেই মূল কম্পিউটার বলল, আমার সার্কিট-ঘরে আমি লুকাসের গলার স্বর অনুকরণ করে আপনার সাথে কথা বলছিলাম। আপনার সাথে প্রতারণা করার জন্যে আমি দুঃখিত, কিন্ত আমার নিজেকে রক্ষা করার অন্য কোনো উপায় ছিল না।
আমি কোনো কথা বলতে পারলাম না, নিজের কানকেও আমার বিশ্বাস হচ্ছিল না, গভীর হতাশা হঠাৎ এসে আমাকে গ্রাস করে। জীবনের কত কাছাকাছি চলে এসে আবার ফিরে যেতে হবে। মূল কম্পিউটার যান্ত্রিক স্বরে বলল, মহামান্য কিম জুরান, এখন আপনাকে ক্যাপসুলে ঢুকতে হবে। বাইরে থাকা আপনার জন্যে বিপজ্জনক।
নিস্ফল আক্রোশে আমি কম্পিউটারের গলার স্বর লক্ষ্য করে স্ক্রু ড্রাইভারটা ছুঁড়ে দিই। একটা মনিটরে লেগে সেটা চুরমার হয়ে যায়, তার টুকরাগুলো আমার চারদিকে ভেসে বেড়াতে থাকে।
আপনি ছেলেমানুষের মতো ব্যবহার করছেন কিম জুরান। মূল কম্পিউটার শান্ত স্বরে বলল, আপনি নিজে থেকে ক্যাপসুলে প্রবেশ না করলে আমি জোর করতে বাধ্য হব। আপনাকে বাঁচানোর জন্যে এখন লুকাস নেই, তাকে আপনি নিজের হাতে শেষ করে এসেছেন।
আমি হঠাৎ নূতন করে উপলব্ধি করলাম যে, এই মুহূর্তগুলো আমার জীবনের শেষ মুহূর্ত। ক্যাপসুলের ভেতর সেই ভয়াবহ পরিবর্তনই হোক, আর বাইরে নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে মারা যাওয়াই হোক, আমার জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটবে এখনই! মারা যাওয়ার আগে কীভাবে এই পিশাচ কম্পিউটারটির উপরে একটা প্রতিশোধ নেয়া যায়, সেটাই আমার মাথায় ঘুরপাক খেতে থাকে।
হঠাৎ করে পুরো মহাকাশযানটি বরফের মতো শীতল হয়ে আসে। আমি দু হাতে নিজের শরীরকে আঁকড়ে ধরে শিউরে উঠি, কী ভয়ানক ঠাণ্ডা, কেউ যেন আমাকে বরফশীতল পানিতে ছুড়ে দিয়েছে। কম্পিউটারের গলার স্বর শুনতে পেলাম, মহামান্য কিম জুরান, ক্যাপসুল আপনার জন্যে উষ্ণ করে রাখা হয়েছে।
ধীরে ধীরে ক্যাপসুলের দরজা খুলে যায়, ভেতর থেকে একটা আরামদায়ক উষ্ণতা মহাকাশযানের ভেতরে ছড়িয়ে পড়ে। আমি লোভীর মতন ক্যাপসুলের দিকে এগোতে গিয়ে থেমে পড়ি, কী হবে উষ্ণ নিরাপদ আশ্রয়ে গিয়ে? কষ্ট করে এই তুহিন শীতল মহাকাশযানে আর কয়েক মিনিট থাকতে পারলেই তো আমার হাইপোথার্মিয়া হয়ে যাবে, তখন কেউ আর আমাকে বাঁচাতে পারবে না। বেঁচে থাকার চেষ্টা করে আর লাভ কী?
আসুন কিম জুরান, কম্পিউটার একঘেয়ে গলায় বলতে থাকে, বাতাস থেকে এখন আমি অক্সিজেন সরিয়ে নিচ্ছি, বাইরে আপনার নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হবে।
সত্যি সত্যি আমার নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হতে থাকে, বারবার বুক ভরে বাতাস নিয়েও মনে হতে থাকে শ্বাস নিতে পারছি না। কী কষ্ট কী যন্ত্রণা! প্রচণ্ড শীতে ঠকঠক করে কাঁপতে কাঁপতে আমি পাগলের মতো নিঃশ্বাস নিতে থাকি, কিন্তু তবু আমার দম বন্ধ হয়ে আসতে থাকে।