লানা? লুকাস একটু ইতস্তত করে জিজ্ঞেস করল, লানা কে?
আমি অবাক হয়ে বললাম, তোমার বান্ধবী, যাকে বিপণিকেন্দ্রের সামনে গুলি করে মারা হল।
ও, তাই নাকি? লুকাস খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে, আমার স্মৃতির ঐ অংশটুক পাঠানো হয় নি। আমি এখন জানি না লানা কে।
প্রসঙ্গটি তোলার জন্যে আমার নিজের উপর রাগ ওঠে। লুকাস কৌতূহলী স্বরে বলল, লানা কি আমার ঘনিষ্ঠ বান্ধবী ছিল? তাকে কি আমার সামনে গুলি করেছিল?
আমি ইতস্তত করে বললাম, লুকাস, ঘটনাটি সুখকর নয়, তুমি যখন জান না, শুনে কী করবে, খামোকা কষ্ট হবে।
ঠিকই বলেছেন। তা ছাড়া আমাদের হাতে সময়ও বেশি নেই। লুকাস সুর পাল্টে বলল, এখন তাহলে আমার পরিকল্পনাটুকু শুনুন। আমি মহাকাশযানটি ফিরিয়ে নিতে চাই। তা করতে হলে মূল কম্পিউটারের কয়েকটা গুরুত্বপূর্ণ প্রসেসর আমার দখল করে নেয়া প্রয়োজন, আমি সেটা করতে পারছি না, কাজেই আপনার সাহায্য দরকার।
কীভাবে?
আপনি কম্পিউটারের মূল ইলেকট্রনিক সার্কিট থেকে কয়েকটা গুরুত্বপূর্ণ আই.সি.তুলে নেবেন। সার্কিটে সেগুলো বড় বড় সকেটে লাগানো আছে, আপনি গিয়ে ভ্রু ড্রাইভার দিয়ে খুলে নেবেন। আমি বলব কোনগুলো খুলতে হবে। সেটা যদি করতে পারেন, মূল কম্পিউটার দুর্বল হয়ে পড়বে, আমি তখন তাকে দখল করে নিতে পারব।
কোথায় আছে কম্পিউটারের আই.সি.গুলো?
আপনাকে বলে দেব। সেখানে যাওয়ার আগে আপনাকে একটা স্পেস স্যুট পরে নিতে হবে। এখানে একটা আছে আমি জানি, কী অবস্থায় আছে জানি না। আশা করছি ভালোই আছে। এটা পরে উপরে উঠে যাবেন, ডানদিকের দরজাটা খুলে ফেললে আপনি ইলেকট্রনিক সার্কিটের ভেতর সরাসরি ঢুকে যেতে পারবেন। সেখানে পেছনের দিকে দেখবেন দুই হাজার পিনের আই.সি.—উপরে বড় সোনালি রঙের রেডিয়েটর, ভুল হওয়ার কোনো উপায় নেই। এক সারিতে নয়টা আছে, নয়টাই তুলে ফেলবেন।
বেশ। তোলা কঠিন নয় তো?
না, দু’পাশে দু’টি ছোট স্তু দিয়ে লাগাননা, তুলতে না পারলে ভেঙে দেবেন—জিনিসটা নষ্ট করা নিয়ে কথা।
ঠিক আছে। বাতাসে ভেসে থেকে আমার অভ্যাস নেই, একটু পরেপরেই আমি উল্টেপাল্টে যাচ্ছিলাম। সেই অবস্থায় কোনোভাবে একটা ইলেকট্রনিক মডিউলের হাতল ধরে ঝুলতে ঝুলতে আমি লুকাসের সাথে কথা বলতে থাকি।
স্পেস স্যুটটা কোথায়?
ডানদিকের গোল ঢাকনাওয়ালা বাক্সে। এটি আধা ঘন্টার বেশি ব্যবহার করা যায় না, কাজেই আধা ঘন্টার মাঝে ফিরে আসতে হবে।
ঠিক আছে।
বেশি পরিশ্রম করবেন না, তাহলে খিদে পেয়ে যাবে আপনার, এই মহাকাশযানে কোনো খাবার নেই, আপনি হয়তো জানেন না।
খাবার নেই? কী সর্বনাশ!
আমি দুঃখিত, খাবারের জন্যে আপনাকে এখনো প্রায় নয় মাস অপেক্ষা করতে হবে। কাজেই তাড়াতাড়ি কাজ শেষ করে ঘুমিয়ে পড়ুন।
আগে আমি কখনো স্পেস স্যুট পরিনি, তবু এটা পরতে বেশি সময় লাগল না, কীভাবে পরতে হয় খুটিনাটি সবকিছু লেখা রয়েছে। দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে স্পেস স্যুটটা তৈরি হয়েছে, কাজেই পরা বেশ সহজ। ভেতরে বাতাসের চাপ ঠিক করে যোগাযোগের ব্যবস্থা করলাম, সাথে সাথে মূল কম্পিউটারের কথা শোনা গেল, মহামান্য কিম জুরান, আপনি কী করতে চাইছেন?
লুকাস বলল, কিম জুরান, আপনি ওর কোনো কথা শুনবেন না, আপনাকে অনেকভাবে ভয় দেখাতে চাইবে, কিচ্ছু বিশ্বাস করবেন না। সোজা উপরে চলে যান, কাজ শেষ করে ফিরে এসে আমাকে ডাকবেন। আমাকে এখন সরে পড়তে হবে।
মূল কম্পিউটার গম্ভীর গলায় বলল, মহামান্য কিম জুরান, আপনি নিশ্চয়ই লুকাসের কথা শুনে উপরে যাচ্ছেন না?
আমি কোনো কথা না বলে ভেসে ভেসে উপরে উঠে এসে দরজাটা ভ্রু ড্রাইভার দিয়ে খুলতে থাকি।
মূল কম্পিউটার কঠোর গলায় বলল, মহামান্য জুরান, আপনি জানেন এই দরজা খোলা নিষেধ, এটা খোলার জন্যে আপনাকে আমি শেষ করে দিতে পারি?
দিচ্ছ না কেন? আমি দরজা খুলে ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে বললাম, তোমাকে নিষেধ করেছে কে?
ভিতরে আরেকটা দরজা রয়েছে, বাতাসের চাপ রক্ষার জন্যে এ ধরনের দরজা থাকে, সেটি ঠেলে ভেতরে ঢুকতেই প্রচণ্ড আলোতে আমার চোখ ধাধিয়ে যায়। যতদূর দেখা যায় শুধু চৌকোনা আই.সি.। মানুষের মস্তিষ্কে ঢুকতে পারলে বুঝি এরকম নিউরোন সেল দেখা যেত।
মহামান্য জুরান, ফিরে যান। এখানকার প্রত্যেকটা আই.সি. প্রয়োজনীয়, এর একটা একটু ওলটপালট হলে মহাকাশযান চিরদিনের মতো অচল হয়ে যেতে পারে, সারাজীবনের জন্যে আমরা এখানে আটকে থাকব! যদি ভুল করে একটা প্রয়োজনীয় আই. সি. তুলে ফেলেন, মুহূর্তে পুরো মহাকাশযান বিস্ফোরণে ধ্বংস হয়ে যেতে পারে।
আমি কম্পিউটারের কথায় গুরুত্ব না দিয়ে ভেসে ভেসে সামনে এগোতে থাকি। একেবারে সামনের দিকে দুই হাজার পিনের বড় বড় আই.সি.গুলো থাকার কথা। উপরে চৌকোনা সোনালি রেডিয়েটর থাকবে, ভুল হবার কোনো আশঙ্কা নেই। ডানদিক থেকে গুনে গুনে সাত নম্বরটা থেকে শুরু করতে হবে। নয়টা প্রসেসর তোলার কথা, তাহলেই আমার কাজ শেষ।
মহামান্য কিম জুরান, কম্পিউটার এবারে অনুনয় শুরু করে, আপনি ফিরে যান। আপনি জানেন না আপনি কী ভয়ানক কাজ করতে যাচ্ছেন। চোখের পলকে আমরা ধ্বংস হয়ে যাব।
আমি সামনে বড় বড় প্রসেসরগুলো দেখতে পেলাম, উপরে সোনালি চৌকোনা রেডিয়েটর, আশেপাশে এরকম কিছু নেই, ভুল হবার কোনো উপায় নেই। ডানদিক থেকে সাত নম্বরটা বের করে আমি ছোট ছোট স্কু দু’টি খুলতে শুরু করি। কম্পিউটার এবার কাতর গলায় প্রাণভিক্ষা চাইতে শুরু করে, মহামান্য কিম জুরান, আপনার কাছে আমি প্রাণভিক্ষা চাইছি। এই প্রসেসরটা আমার প্রাণের মতো, এটা তুলে ফেললে আমি প্রাণহীন হয়ে যাব, আমাকে বাঁচতে দিন। আপনাকে কথা দিচ্ছি আমি মহাকাশযানটা ঘুরিয়ে আপনাকে নিয়ে পৃথিবীতে ফিরে যাব। বিশ্বাস করেন আমাকে, আমি কম্পিউটার, কম্পিউটার কখনো মিথ্যা কথা বলে না।