মূল কম্পিউটার উত্তর দেবার পরিবর্তে একটা আর্তচিৎকার করে ওঠে। মহাকাশযানের আলো কিছুক্ষণ নিবুনিবু থেকে পুরোপুরি নিভে গেল। আমি ভীতস্বরে ডাকলাম, লুকাস।
লুকাস চাপাস্বরে হাসতে হাসতে বলল, কি?
কী হচ্ছে এখানে?
কম্পিউটারের ছয় মেগাবাইট মেমোরি শেষ করে দিয়েছি। কথা বলার জন্যে। একটা চ্যানেল খোলা রেখেছিল, একটু ব্যস্ত হতেই বিদ্যুতের মতো ঢুকে গেলাম, মুহূর্তে ছয় মেগাবাইট মেমোরির জায়গায় ছয় মেগাবাইট জঞ্জাল! এখন ঘন্টাখানেক সময় ব্যস্ত থাকবে, মেমোরিটা ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করবে।
অন্ধকার হয়ে গেল কেন?
মেমোরির সাথে সাথে আলোর প্রসেসরটাও গেছে নিশ্চয়ই। ইমার্জেন্সি আলোটা জ্বেলে দিই।
ধীরে ধীরে ইমার্জেন্সির ঘোলাটে আলো জ্বলে ওঠে। আমি ভাসতে ভাসতে সাবধানে একটা বড় ইলেকট্রনিক মডিউল ধরে নিজেকে সামলে রেখে জিজ্ঞেস করলাম, লুকাস, তুমি কম্পিউটারের সাথে এভাবে লুকোচুরি খেলে টিকে থাকতে পারবে?
চেষ্টা করতে দোষ কী? সম্ভাবনা চল্লিশ দশমিক তিন আট, খারাপ না।
তোমার পরিকল্পনাটা কি?
আপনাকে পৃথিবীতে ফিরিয়ে নেয়া।
আমি এক মুহূর্ত চুপ থেকে জিজ্ঞেস করি, কী জন্যে, বলবে?
লুকাস শব্দ করে হেসে বলল, একজনের অনুরোধ।
আমি চমকে উঠে জিজ্ঞেস করি, কার অনুরোধ?
নীষা নামের একটি মেয়ের। আপনি যার হাত ধরে বলেছেন, চিরদিনের মতো। ঘুমিয়ে পড়ার আগে তার কথা ভাববেন।
আমি কী বলব বুঝতে না পেরে চুপ করে থাকি। লুকাস শব্দ করে হেসে উঠে বলল, নীষা বড় বেশি অনুভূতিপ্রবণ! আপনাকে নাকি বলেছিল যে আপনার কোনো ভয় নেই। সে এরকম অবস্থায় সবসময় সান্ত্বনা দেয়ার জন্যে বলে, কেউ কখনো বিশ্বাস করে না। আপনি নাকি তার কথা বিশ্বাস করে ফেলেছিলেন। সত্যি নাকি?
হ্যাঁ।
তাই সে আমাকে অনুরোধ করেছে। বিশ্বাসের অমর্যাদা করা নাকি ঠিক না।
নীষার সাথে তোমার পরিচয় কেমন করে?
সেটি অনেক বড় কাহিনী, আরেকদিন বলব। এখন শুধু জেনে রাখেন, আমরা রবোট্রনেরা যে-কাজটি করার চেষ্টা করছি, নীষা তাতে সাহায্য করে।
আমার হঠাৎ একটা জিনিস মনে হল, জিজ্ঞেস করব না, করব না ভেবেও জিজ্ঞেস করে ফেললাম, নীষা কি মানুষ, না রবোট্রন?
লুকাস খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে উচ্চস্বরে হেসে ওঠে, বলে, কোনটা হলে আপনি খুশি হবেন?
আমি লজ্জা পেয়ে বললাম, এতে খুশি আর অখুশির কোনো ব্যাপার নেই, লুকাস।
তাহলে জানতে চাইছেন কেন?
এমনি, কৌতূহল।
ঠিক আছে, আপনিই বের করবেন, আমি বলব না, দেখি বের করতে পারেন কী না।
আবার যদি কখনো দেখা হয়।
আমার কপোট্রন বলছে দেখা হবে, না হয়ে যায় না।
আমি কথা ঘোরানোর জন্যে বললাম, আমাদের বেঁচে যাওয়ার সম্ভাবনা চল্লিশ দশমিক তিন আট, যার অর্থ আমাদের হেরে যাওয়ার আশঙ্কা বেশি।
হ্যাঁ।
এত বড় ঝুঁকি নেয়া কি তোমার উচিত হল? আমি তো আমার আশা ছেড়েই দিয়েছিলাম, কিন্তু তোমার জীবনের সব আশা তো তুমি ছাড় নি, তুমি কেন এত বড় ঝুঁকি নিলে?
আমি কোনো ঝুঁকি নিই নি। যদি মূল কম্পিউটার তোমাকে ধ্বংস করে দেয়?
কিম জুরান, আপনি ভুলে যাচ্ছেন আমি রবোট্রন। আমাদের স্মৃতি স্থানান্তর করা সম্ভব। অত্যন্ত প্রয়োজন না হলে সেটা করা হয় না, কিন্তু করা সম্ভব। আমরা ইচ্ছা করলে সবসময়েই আমাদের স্মৃতির একটা কপি কোথাও বাঁচিয়ে রাখতে পারি, তাহলে আমাদের কখনোই মৃত্যু হবে না। যখনই কোনো রবোট্রন ধ্বংস হয়ে যাবে, নতুন কোনো রবোর্টুনের কপোট্রনে সেই স্মৃতি ভরে নেয়া যাবে, সে তাহলে আবার প্রাণ ফিরে পাবে। আগে সেটা করা হত, কিন্তু দেখা গেছে রবোট্রনেরা তাহলে অনাবশ্যক ঝুঁকি নেয়, বেপরোয়া হয়ে যায়। সবাই জানে তাদের শরীর ধ্বংস হয়ে গেলেও তাদের স্মৃতি বেঁচে থাকবে, আবার তারা নূতন জীবন শুরু করতে পারবে, তাই কোনোকিছুকে আর পরোয়া করত না। তখন ঠিক করা হল, আমাদের স্মৃতির কপি রাখা হবে না, মানুষের মতো আমাদের শরীরই হবে আমাদের সবকিছু, শরীর ধ্বংস হলেই আমরা ধ্বংস হয়ে যাব। সেই থেকে রবোট্রনেরা আর নিজেদের শরীরকে নিয়ে ছেলেখেলা করে না মানুষের মতো নিজের শরীরের যত্ন নেয়। কিন্তু খুব যখন প্রয়োজন হয়, তখন স্মৃতিকে কপি করা হয়। আপনাকে উদ্ধার করার জন্যে আমার স্মৃতির একটা অংশ কপি করে এখানে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে।
একটা অংশ? পুরোটা নয় কেন?
দু’টি কারণে। প্রথমত, পুরোটার প্রয়োজন নেই; দ্বিতীয়ত, রবোট্রনের স্মৃতি বিরাট বড়, পুরোটা পাঠানো সোজা ব্যাপার নয়। গোপন একটা জায়গা থেকে স্মৃতিটা বাইনারী কোডে পাঠানো হয়েছিল, মূল কম্পিউটার সরল বিশ্বাসে সেটা গ্রহণ করেছে, ভেবেছে পৃথিবী থেকে তাকে কোনো নির্দেশ পাঠানো হচ্ছে। আমি মেমোরিতে ছিলাম, মূল কম্পিউটার যখন তার মূল প্রসেসরের ভেতর দিয়ে পাঠানো শুরু করল, আমি একটা প্রয়োজনীয় মাইক্রো প্রসেসর দখল করে নিয়েছি। সেই প্রসেসর এবং খানিকটা মেমোরি নিয়ে আমার রাজত্ব। ব্যাপারটা বেশ জটিল, এত অল্প সময়ে বোঝানো সম্ভব না, শুধু জেনে রাখেন আমি একটা কম্পিউটার প্রোগ্রাম, কম্পিউটারের মূল প্রোগ্রামের বিনা অনুমতিতে আমি কাজ করছি!
আমি খুঁটিনাটি বুঝতে না পারলেও মোটামুটি ব্যাপারটা কী হচ্ছে বুঝতে অসুবিধে হল না। যে-জিনিসটা সবচেয়ে চমকপ্রদ মনে হল সেটা হচ্ছে, যদিও লুকাস আমাকে বাঁচানোর জন্যে এখানে এসেছে, কিন্তু সত্যিকারের লুকাস এখন পৃথিবীতে। আমার হঠাৎ লুকাসের বান্ধবী লানার কথা মনে পড়ল, তার স্মৃতির একটা কপি যদি বাঁচিয়ে রাখা হত, তাহলে আবার তাকে বাঁচিয়ে তোলা যেত। লুকাসকে জিজ্ঞেস না করে পারলাম না, লানার স্মৃতির কোনো কপি কি বাঁচিয়ে রাখা হয়েছিল?