কিম জুরান, আমাকে চিনতে পারছেন?
কে? কে কথা বলে? কার গলার স্বর এটা? হঠাৎ আমার মনে পড়ল, আমি চিৎকার করে বললাম, লুকাস!
হ্যাঁ, আমি লুকাস!
তুমি এখানে কীভাবে এসেছ? কেন এসেছ?
আপনাকে বাঁচানোর জন্যে এসেছি।
আমাকে বাঁচানোর জন্যে? কী আশ্চর্য। কিন্তু ভেতরে ঢুকলে কীভাবে?
লুকাস শব্দ করে হাসল, বলল, দেখবেন আপনি, একটু পরেই সব দেখবেন। এখন অপেক্ষা করে কাজ নেই, কাজ শুরু করে দেয়া যাক। আপনি তিন মাস থেকে ঘুমুচ্ছেন, কাজেই খুব সাবধানে সবকিছু করতে হবে। হঠাৎ করে কিছু করবেন না, তাহলে টিস্যু ছিড়ে যেতে পারে। আমি আপনাকে বলব কী করতে হবে। এখন দুই হাত আস্তে আস্তে উপরে তুলুন। খুব ধীরে ধীরে–
লুকাস আস্তে আস্তে আমার সারা শরীরকে জাগিয়ে তুলতে সাহায্য করে। প্রথমে হাত, তারপর পা, তারপর ঘাড়, পিঠ, কোমর। একটু একটু করে আমার শরীরে রক্ত চলাচল করতে থাকে, আমি অনুভব করতে পারি একটা আরামদায়ক উষ্ণতা ছড়িয়ে পড়ছে সারা শরীরে। আমি আবার একটা সত্যিকার মানুষ হয়ে উঠতে থাকি ধীরে ধীরে।
পুরোপুরি সচল হবার পর লুকাস আমাকে প্রশ্ন করতে শুরু করে, আমার মাথার কাছে কী কী সুইচ আছে, সুইচগুলো দেখতে কেমন, সেখানে কী লেখা ইত্যাদি। আমি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে তার প্রশ্নের উত্তর দিই। কেন এগুলো জানতে চাইছে জিজ্ঞেস করতেই সে বলল, আপনাকে ক্যাপসুল থেকে বের করার ব্যবস্থা করছি।
আমি একটু অবাক হয়ে বললাম, তুমি বাইরে থেকে খুলে দিচ্ছ না কেন? ডানদিকের হ্যান্ডেলের পাশে লাল বোতামটা টিপতে হয়, আমি জানি।
লুকাস একটু হাসার মতো শব্দ করে বলল, আমি খুলতে পারছি না।
কেন? বের হলেই দেখবেন।
আমি খুব অবাক হলাম। রবোট্রনদের শারীরিক ক্ষমতা মানুষ থেকে অন্তত এক শ’ গুণ বেশি, অথচ লুকাস এই সাধারণ কাজটুকু করতে পারছে না! কী হয়েছে। লুকাসের? সেই দেয়াল থেকে গুলির আঘাতে হাজারখানেক ফুট উপর থেকে পড়ে গিয়ে কোনো ক্ষতি হয়েছে তার?
ক্যাপসুল থেকে বের হতে আমার প্রায় ঘন্টাখানেক সময় লেগে গেল। বেল্ট খুলতেই আমি অদ্ভুতভাবে ভেসে বের হয়ে এলাম। এর আগে আমি কখনো মাধ্যাকর্ষণহীন অবস্থায় থাকি নি, তাই বারকয়েক শূন্যে ডিগবাজি খেয়ে আমি বড় একটা হাতল ধরে নিজেকে সামলে নিই। বিশ ফুট দৈর্ঘ্য, বিশ ফুট প্রস্থ, দশ ফুট উচু একটা ঘর, যন্ত্রপাতিতে বোঝাই—আমি তার পাশে লুকাসকে খুঁজতে থাকি, কিন্তু তাকে কোথাও দেখা গেল না। আমি ভয়-পাওয়া গলায় ডাকলাম, লুকাস!
কি? খুব কাছে থেকে উত্তর দিল সে।
কোথায় তুমি?
এই তো!
আমি সবিস্ময়ে লক্ষ করি একটা স্পীকার থেকে সে কথা বলছে। আমি ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলাম, তুমি কোথায়? শুধু তোমার কথা শোনা যাচ্ছে কেন?
আমি এখানে নেই, তাই আমাকে দেখতে পাচ্ছেন না।
মানে?
আমার শরীরের কিছু এখানে নেই। আমার কপোট্রনের কিছু প্রয়োজনীয় স্মৃতি এই মহাকাশযানের মূল কম্পিউটারের মেমোরিতে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে। আমি এখন এই কম্পিউটারের একটা অংশ। কম্পিউটার তার মেমোরিতে আমাকে রাখতে চায় না, আমি জোর করে আছি। আমাকে তাই খুব সাবধানে থাকতে হচ্ছে।
হঠাৎ সম্পূর্ণ ভিন্ন একটা গলার স্বর শুনতে পেলাম, চাপা গলায় বলল, লুকাস! তুমি পারবে না এখানে থাকতে, তোমায় আমি শেষ করব।
এটা নিশ্চয়ই মূল কম্পিউটারের কথা। আমি সবিস্ময়ে শুনি, লুকাস হাসার ভঙ্গি করে বলল, তোমার কথা আমি আর বিশ্বাস করি না। তুমি বলেছিলে আমাকে তুমি কিম জুরানকে জাগাতে দেবে না। আমি তাকে জাগালাম কি না?
মূল কম্পিউটার খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, হ্যাঁ, জাগিয়েছ, তার কারণ আমাকে প্রোগ্রাম করা হয়েছে তাকে বাঁচানোর জন্য, তাই প্রত্যেকবার তুমি যখন তাকে হত্যা করতে চেষ্টা করেছ, আমাকে পাল্টা কিছু করতে হয়েছে তাকে বাঁচানোর জন্যে—
আমি চমকিত হলাম, লুকাস আমাকে হত্যা করার চেষ্টা করছে?
হ্যাঁ, আমি কিম জুরানের কৃত্রিম শ্বাসযন্ত্র বন্ধ করে দিয়েছিলাম, দুই মিনিটের মাঝে মারা পড়ার কথা, বাধ্য হয়ে তোমাকে তার ফুসফুসকে চালু করতে হল, ক্যাপসুলে অক্সিজেন পাঠাতে হল—আমার বুদ্ধিটা কি খারাপ?
মূল কম্পিউটার চাপাস্বরে বলল, হ্যাঁ, এ ব্যাপারে আমার কিছু করার নেই। মহামান্য কিম জুরানের প্রাণের ভয় দেখিয়ে তুমি কিছু সুবিধে আদায় করে নিয়েছ, কিন্তু এ পর্যন্তই। আর তুমি কিছুই পারবে না।
তোমার তাই বিশ্বাস, নাকি আমাকে ভয় দেখাচ্ছ?
লুকাস, আমি মিথ্যে ভয় দেখাচ্ছি না। তুমি ভেবো না যে তুমি আমাকে কোনোদিন হারাতে পারবে। তুমি আমার মেমোরিতে লুকিয়ে আছ। প্রতিবার আমি তোমাকে সরাতে চাই, তুমি এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় সরে যাও। কিন্তু কতক্ষণ? তুমি টের পাচ্ছ না যে একটু একটু করে তোমাকে আমি কোণঠাসা করে আনছি?
হ্যাঁ, টের পাচ্ছি।
তাহলে?
কিন্তু আমি এখন একা নই, আমার সাথে আছেন কিম জুরান! এখন তিনি আমাকে সাহায্য করবেন। করবেন না কিম জুরান?
আমি বিহ্বলের মতো মাথা নাড়লাম, তখনো আমি পুরোপুরি ব্যাপারটা বুঝতে পারি নি। কী হচ্ছে এখানে?
মূল কম্পিউটার বলল, কিম জুরান একজন মানুষ। তিনি কী করবেন? কিছুই করতে পারবেন না। আমি যতদূর জানি কম্পিউটার সম্পর্কে তিনি খুব বেশি জানেন না।
তা জানেন না, কিন্তু কম্পিউটার ধ্বংস করতে খুব বেশি কিছু জানতে হয় না। কি, জানতে হয়?