তার কারণ আমার চারপাশে কী আছে তাতে আমার কিছু আসে যায় না। আমার প্রয়োজন ছোট একটা ডেস্ক, ভাবনা করার জন্য নিরিবিলি একটু জায়গা।
পৃথিবীর কী নিরবিলি জায়গা নেই নীহা?
আছে।
তাহলে কেন মহাকাশযানের অনিশ্চিত জীবন বেছে নিতে চাইছ?
তার কারণ পৃথিবীতে থাকলে আমার চারপাশের সমাজ আমাকে সুনির্দিষ্ট কিছু দায়িত্ব পালন করতে বলবে। আমাকে নিরিবিলি বসে থাকতে দিবে না।
মহাকাশযানে তোমাকে নিরিবিলি বসে থাকতে দেবে?
দেবে। সেখানে মানুষের কোনো দায়িত্ব নেই। মহাকাশযান চালানোর জন্যে শক্তিশালী কম্পিউটার থাকে। তাছাড়া–
তাছাড়া কী, নীহা?
মহাকাশযানে ওঠার পর আমাদের শীতল ঘরে দীর্ঘদিনের জন্যে ঘুম পাড়িয়ে দেবে। আমার এই ব্যাপারটা নিয়ে আগ্রহ আছে।
কী ধরনের আগ্রহ?
তাপমাত্রা কমিয়ে শরীরের সকল অঙ্গপ্রত্যঙ্গ বিকল করে রাখলেও মস্তিষ্কের কোনো একটি ধাপ সচল থাকে বলে আমার ধারণা। আমি দীর্ঘ যাত্রায় মস্তিষ্কের সেই সচল অংশটুকু ব্যবহার করে দেখতে চাই।
নীহা।
বল।
তুমি কী জান তুমি খুব অদ্ভুত একটি মেয়ে।
(নিরুত্তর)
নীহা।
বল।
তুমি আমার প্রশ্নের উত্তর দাও।
এটি আরেকটি কারণ।
কোনটি আরেকটি কারণ নীহা?
জন্মের পর থেকে আমি শুনে আসছি যে আমি অদ্ভুত একটি মেয়ে। তাই আমি এমন একটা জায়গায় যেতে চাই সেখানে পৃথিবীর কেউ নেই। কেউ যেন আমাকে না বলে আমি অদ্ভুত একটি মেয়ে।
নীহা।
বল।
আমার ধারণা বহুদূর কোনো গ্রহেও তোমাকে বলা হবে তুমি অদ্ভুত একটি মেয়ে।
(নিরুত্তর)
তুমি কী তবুও মহাকাশযান করে যেতে চাও?
হ্যাঁ।
যেতে চাই।
তোমার নাম কী?
আমার নাম সুহা।
তোমার সাথে যে শিশুটি আছে তার নাম কী?
ক্লদ।
সে তোমার কী হয়?
ক্লদ আমার ছেলে।
আমি তার মা।
সুহা, তোমার বয়স কতো?
আমার বয়স ছাব্বিশ।
ক্লদের বয়স কত? চার।
তুমি তোমার চার বছরের সন্তানকে নিয়ে মহাকাশযানে করে এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতে রওনা দিতে চাও?
আমি ব্যাপারটি সেভাবে দেখছি না।
তুমি ব্যাপারটি কীভাবে দেখছ?
আমি মনে করি আমার চার বছরের ছেলেকে নিয়ে এই মহাকাশযানে করে দূর মহাকাশে রওনা দিতে পারলে আমি আমার সন্তানের জীবন নিশ্চিত করতে পারব।।
তুমি কেন এই কথা বলছ?
কারণ আমি জানি রবোমানবেরা পৃথিবী দখল করে নেবে। তখন তারা কোনো মানুষকে রাখবে না। যদিবা রাখে তাদেরকে রবোমানবের আজ্ঞাবহ নিচু শ্রেণীর নাগরিক হিসেবে থাকতে হবে। আমি আমার সন্তানের জন্যে সেই ধরনের জীবন চাই না। আমি তাকে মানুষের সম্মানিত জীবন দিতে চাই।
তুমি কেন বলছ এই পৃথিবী রবোমানবেরা দখল করে নেবে।
তার কারণ আমি দেখতে পাচ্ছি তারা প্রায় দখল করে ফেলছে।
তুমি কীভাবে সেটা জান সুহা?
সংবাদ মাধ্যমে আগে রবোমানব খুঁজে পাওয়ার খবর দেয়া হতো। এখন দেয়া হয় না। যার অর্থ রবোমানবদের আর খুঁজে বের করা সম্ভব হচ্ছে না। কিংবা–
কিংবা কী?
কিংবা শৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনীতে রবোমানবেরা ঢুকে গেছে যেটি আরো বিপজ্জনক।
তুমি কী মানুষের কর্মদক্ষতাকে বিশ্বাস কর না?
করি। কিন্তু—
কিন্তু কী সুহা?
রবোমানবেরাও এক ধরনের মানুষ। আমাদের যা আছে তাদেরও তার সবকিছু আছে। তাদের একটা বাড়তি জিনিস আছে, সেটা হচ্ছে থ্যালামাসে ইমপ্ল্যান্ট করে দেয়া নিউরন স্টিমুলেটর। সেটা তাদের মস্তিষ্ককে অনেক বেশি দক্ষ করে তুলেছে। আমি নিশ্চিতভাবে জানি এই রবোমানবেরা খুব তাড়াতাড়ি পৃথিবী দখল করে নেবে। আমি তার আগে পৃথিবী ত্যাগ করতে চাই।
তোমার চার বছরের ছেলে ক্লদ? সেও কী যেতে চায়?
ক্লদকে এখনো স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নিতে দেয়া হয় না।
ক্লদের বাবা?
আমি তার সম্পর্কে কথা বলতে চাই না।
কেন?
কারণ আমি তার সম্পর্কে একটি ভালো কথাও বলতে পারব না। আমি ক্লদের সামনে কিছু বলতে চাই না।
ঠিক আছে। আমি কী ক্লদের সাথে একটু কথা বলতে পারি?
পার।
ক্লদ।
উঁ। তুমি কী জান তুমি কোথায় যাচ্ছ।
জানি।
কোথায়?
আকাশে।
আকাশে কোথায়?
রাত্রিবেলা যে তারাগুলো মিটমিট করে সেখানে।
সেখানে গিয়ে তুমি কী করবে?
আমি তারাগুলো ধরে একটা কাচের বোতলে রাখব। রাত্রিবেলা সেগুলো বোতলের ভেতর মিটমিট করবে।
চমৎকার ক্লদ। তোমাকে আরেকটা জিনিস জিজ্ঞেস করতে পারি?
পার। তুমি তোমার মাকে কতটুকু ভালোবাস?
অনেকটুকু। এই ঘরের সমান। আরো বেশি।
চমৎকার ক্লদ। চমৎকার।
০৪. ঘরটি ছোট, ঘরের ছাদ বেশ নিচু
ঘরটি ছোট, ঘরের ছাদ বেশ নিচু, ইচ্ছে করলে হাত দিয়ে স্পর্শ করা যায়। ঘরটির মাঝে একটি ধাতব টেবিল, টেবিল ঘিরে তেরোজন নারী-পুরুষ বসে আছে। ঘরটির ভেতর নিরানন্দ পরিবেশ কিন্তু ঠিক কেন সেটি নিরানন্দ হঠাৎ করে বোঝা যায় না। ধাতব টেবিলের একপাশে যে বসে আছে তার চেহারায় এক ধরনের কাঠিন্য লুকিয়ে আছে। সে টেবিলে থাবা দিতেই টেবিলের চারপাশে বসে থাকা নারী ও পুরুষগুলো ঘুরে তার দিকে তাকাল। মানুষটি সুনির্দিষ্ট কারো দিকে না তাকিয়ে বলল, বিজ্ঞান আকাদেমী কী নিয়ে তাদের গোপন সভা করেছে সেটা কি জানা গেছে?
কমবয়সী একটা মেয়ে খিলখিল করে হেসে বলল, আমাদের নিয়ে!
অবশ্যি আমাদের নিয়ে? কিন্তু আমাদের কোন বিষয়টা নিয়ে সেটা জানা গেছে?
মাঝবয়সী একজন মানুষ বলল, মোটামুটি অনুমান করতে পারি।
ঠিক আছে অনুমান কর।
মানুষটি বলল, আমরা রবোমানবেরা নেটওয়ার্ক দখলের দিকে আরো এক ধাপ এগিয়ে গেছি। সমাজের সব জায়গায় আমাদের রবোমানবেরা আছে—তারা গোপনে কাজ করে যাচ্ছে। আগে যেরকম প্রতিদিন মানুষেরা কিছু রবোমানব ধরে ফেলতো-আজকাল সেটা পারছে না। তার প্রধান কারণ–