লাল চুলের মেয়েটি টলতে টলতে এগিয়ে গিয়ে তার ব্যাগ থেকে বেঢপ একটা রিভলবার বের করে এনে ফিসফিস করে বলল, তুমি ঠিকই বলেছ। কিন্তু তোমার মতো বোধশক্তিহীন অনুভূতিহীন অঙ্গপ্রত্যঙ্গহীন একটা মস্তিষ্ক আমাকে করুণা করবে সেটি হতে পারে না।
তুমি কী করবে?
লাল চুলের মেয়েটি কোনো উত্তর দিল না। মস্তিষ্কটি আবার জিজ্ঞেস করল, কী করবে? তুমি কী করবে?
লাল চুলের মেয়েটি খুব ধীরে ধীরে রিভালবারটি নিজের মাথায় স্পর্শ করে। একবার চারিদিকে তাকাল তারপর ট্রিগারটি টেনে ধরে। ছোটঘরটিতে গুলির শব্দটি প্রতিধ্বনিত হয়ে ফিরে আসে।
মস্তিষ্কটি চিৎকার করে জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে? কী হয়েছে এখানে?
কেউ তার কথার উত্তর দিল না। মস্তিষ্কটির চেতনা ধীরে ধীরে অবশ হতে শুরু করেছে। কেউ তাকে বলে দেয়নি কিন্তু সে জানে তার সময় শেষ হয়ে আসছে। নিজের ভেতরে সে তীব্র একটি প্রশান্তি অনুভব করে। আর কিছুক্ষণ তারপরই সে এই অন্ধকার বোধশক্তিহীন চেতনহীন, আদি-অন্তহীন, মমতাহীন জগৎ থেকে মুক্তি পাবে।
সেই তীব্র আনন্দের জন্যে এই হতভাগ্য মস্তিষ্কটি অপেক্ষা করতে থাকে।
২৮.
খুব ধীরে ধীরে নীহার ঘুম ভেঙ্গে যায়। পঞ্চম ঘাত কিনিস্কা রাশিমালা নিয়ে চিন্তা করতে করতে সে ঘুমিয়েছিল, ঠিক যখন সমাধানটা তার মাথায় উঁকি দিতে শুরু করেছে তখন তার চোখ বন্ধ হয়ে এসেছিল। যখন সে চোখ খুলেছে তখন হঠাৎ করে সমাধানটা সে পেয়ে গেছে। নিজের অজান্তেই নীহার মুখে হাসি ফুটে উঠল।
ক্যাপসুলের ভেতর মিষ্টি একটা গন্ধ ছড়িয়ে পড়ছে। একটা মৃদু সংগীতের ধ্বনি শোনা যাচ্ছে, মনে হচ্ছে অনেক দূর থেকে সেটি ভেসে আসছে কিন্তু নীহা জানে এটি ঠিক ক্যাপসুলের ভেতরেই তার জন্যে তৈরি করা সংগীতের ধ্বনি। নীহা তার হাতটি নাড়ানোর চেষ্টা করল, দুর্বলভাবে সেটি একটু নাড়াতে পারল। এখনো তার শরীরে শক্তি ফিরে আসে নি। আরো কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে।
নীহা তার চোখ বন্ধ করে অপেক্ষা করে। সে অনুভব করে সারা শরীরে এক ধরনের উষ্ণতা ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে। এই উষ্ণতাটুকু তার শরীরটাকে জাগিয়ে তুলছে। কতোদিন পর সে জেগে উঠছে? শেষবার যখন জেগে উঠেছিল তখন সেটি ছিল একটি ভয়ংকর দুঃসংবাদের মতো। এবারে? এবারে নিশ্চয়ই ওরকম কিছু নয়। যদি সেরকম কিছু হতো তাহলে ক্যাপসুলের ভেতর এরকম মিষ্টি একটা সংগীতের ধ্বনি তাকে শোনানো হতো না। ক্যাপসুল থেকে বাইরে বের হওয়ার জন্যে সে আর অপেক্ষা করতে পারছে না।
শেষ পর্যন্ত ক্যাপসুলের ঢাকনাটি ধীরে ধীরে খুলে গেল। নীহা ভেতরে ওঠে বসে তারপর সাবধানে ক্যাপসুল থেকে নেমে আসে। একটু দূরে স্বচ্ছ কোয়ার্টজের জানালার পাশে নুট দাঁড়িয়েছিল, নীহার পায়ের শব্দ শুনে মাথা ঘুরিয়ে তাকাল। নীহা মুখে হাসি ফুটিয়ে বলল, নুট! কেমন আছ তুমি?
নীহা ভেবেছিল মুট কোনো কথা বলবে না, মাথা নেড়ে বুঝিয়ে দেবে সে ভালোই আছে। কিন্তু তাকে অবাক কয়ে নুট কথা বলল, আমি ভালোই আছি নীহা! তুমি কেমন আছ?
আমিও ভালো আছি! কিনিস্কা রাশিমালার সমাধানটা মনে হয় পেয়ে গেছি!
চমৎকার। শীতলঘরে তোমার ঘুম কেমন হল?।
নীহা অবাক হবার ভান করে বলল, কী আশ্চর্য নুট! তুমি পর পর দুটি কথা বললে! প্রশ্ন করলে! এমনটি তো আগে কখনো হয় নি।
নুট হেসে ফেলল, বলল, আসলে কোয়ার্টজের এই জানালার পাশে দাঁড়িয়ে বাইরে তাকিয়ে গ্রহটাকে দেখে মনটা ভালো হয় গেছে। তাই কথা বলার ইচ্ছে করছিল। তোমাকে দেখে কথা বলে ফেলছি।
গ্রহ? নীহা অবাক হয়ে বলল, আমরা একটি গ্রহে এসেছি? কেপলার টুটুবি?
মনে হয়।
নীহা টলমলে পায়ে এগিয়ে গিয়ে কোয়ার্টজের জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে বিস্ময়ের একটা শব্দ করল, বলল, কী সুন্দর! ঠিক যেন পৃথিবী।
কেপলার টুটুবি গ্রহটি তোমাদের পছন্দ হয়েছে জেনে ভালো লাগছে।
ট্রিনিটির কণ্ঠস্বর শুনে দুজনেই ঘুরে তাকাল। ট্রিনিটি বলল, এটি আমার খুঁজে পাওয়া তৃতীয় গ্রহ।
তৃতীয় গ্রহ? তুমি এর আগে আরো দুটি গ্রহে গিয়েছ? নীহা অবাক হয়ে বলল, আমাদের ডেকে তোলনি কেন?
গ্রহগুলিকে ঠিক করে উজ্জীবিত করতে পারিনি তাই তোমাদের ডাকিনি।
উজ্জীবিত? গ্রহকে উজ্জীবিত করে কেমন করে?
মানুষ প্রাণী গাছপালা বেঁচে থাকার পরিবেশ তৈরি করাকে বলি উজ্জীবিত করা।
এই গ্রহটিকে পেরেছ?
সহ্য সীমার ভেতরে নিয়ে এসেছি।
সেটা কী, বলবে আমাদের?
বলব। অবশ্যই বলব। তোমাদের আরো তিনজন জেগে উঠুক, তখন এক সাথে বলব।
ট্রিনিটির কথা শেষ হবার আগেই অন্য তিনটি ক্যাপসুলের ঢাকনা খুলে যায়। ভেতর থেকে টলমলে পায়ে ইহিতা, টুরান আর টর একজন একজন করে বের হয়ে আসে।
নীহা আনন্দের মতো শব্দ করে বলল, এসো তোমরা। দেখে যাও। আমরা কেপলার টুটুবি গ্রহে এসেছি। আমাদের গ্রহ।
শীতলঘর থেকে সদ্য ওঠা তিনজন টলমল পায়ে এগিয়ে এসে কোয়ার্টজের জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল, নিজের অজান্তেই তাদের মুখে দিয়ে আনন্দের একটা ধ্বনি বের হয়ে আসে।
ইহিতা বলল, দেখেছ, গ্রহটা ঠিক পৃথিবীর মতো!
ট্রিনিটি বলল, পুরোপুরি নয়। কিছু পার্থক্য রয়েছে, তোমাদের অভ্যস্ত হয়ে যেতে হবে।
কী পার্থক্য? টর জিজ্ঞেস করল, কোনো ভয়ংকর প্রাণী?
না। কোনো ভয়ংকর প্রাণী নেই।
তাহলে?
সূর্যটা বড়। দিনগুলো লম্বা। রাতের আকাশে চাঁদ দুটি।
সেগুলো খুব কঠিন কিছু নয়। দুটি চাঁদ ভালোই লাগবে মনে হয়।