হ্যাঁ। আমি আমার দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করেছি। এর চাইতে সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করা সম্ভব না।
তাহলে কেন পৃথিবীর সব রবোমানব দুই সপ্তাহের মাঝে ধ্বংস হয়ে গেল?
সবাই ধ্বংস হয়নি। তুমি কেন অসংলগ্ন কথা বলছ?
দীর্ঘদেহী মানুষটি এক পা অগ্রসর হয়ে বলল, আমি অসংলগ্ন কথা বলছি। রবোমানব হিসেবে আমি আমার দলপতির কাছে কৈফিয়ত চাইছি।
আমি তোমার কাছে কৈফিয়ত দিতে বাধ্য নই। যেটা হয়েছে সেটা একটা দুর্ঘটনার মতো। আমরা কেউ ভুলেও চিন্তা করিনি মানুষ হয়ে মানুষেরা নিজেরা নিজেদের মাথায় গুলি করবে। নেটওয়ার্ক ধ্বংস করবে।
দলপতি হিসেবে তোমার সবকিছু চিন্তা করা উচিত ছিল।
মধ্যবয়স্ক মহিলাটি বলল, তুমি আমাদের দলপতি। তোমাকে সব দায় দায়িত্ব নিতে হবে।
নিষ্ঠুর চেহারার মানুষটি হঠাৎ এক ধরনের বিপদ আঁচ করতে পারে, সে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে সবার দিকে তাকায়, তোমরা কী বলতে চাইছ?
কেউ কোনো কথা না বলে তার দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল।
নিষ্ঠুর চেহারায় মানুষটি তার পকেটে হাত ঢুকিয়ে একটা রিভলবার বের করার চেষ্টা করে, কিন্তু তার আগেই দীর্ঘদেহী মানুষটি একটি লোহার রড দিয়ে নিষ্ঠুর মানুষটির মাথায় আঘাত করল। একটা কাতর শব্দ করে সে নিচে পড়ে যায়, তার হাতে তখনো রিভলবারটি রয়ে গেছে। দীর্ঘদেহী মানুষটি রিভলবারটি নিজের হাতে নিয়ে নিষ্ঠুর চেহারার মানুষটির মাথার দিকে তাক করল।
লাল চুলের মেয়েটি তার মাথার রুমালটি খুলে চুলগুলো তার পিঠে ছড়িয়ে পড়তে দিয়েছে। সে আংগুল দিয়ে চুলোর জটাগুলো মুক্ত করতে করতে একটু বিরক্ত হয়ে বলল, নির্বোধের মতো কাজ করো না। গুলির শব্দ শুনলে মানুষ
সন্দেহ করবে। ওকে যদি মারতে চাও নিঃশব্দে মেরে ফেল।
মধ্যবয়স্ক মহিলাটি টেবিলের ওপর থেকে উত্তেজক পানীয়ের বোতলটা থেকে খানিকটা পানীয় ঢকঢক করে খেয়ে বলল, যদি ওকে মেরে ফেলবে বলেই ঠিক করেছিলে তাহলে আরেকটু আগে মেরে ফেললে না কেন? আমাদের আধবোতল উত্তেজক পানীয় বেঁচে যেত!
দীর্ঘদেহী মানুষটি লোহার রডটি নিয়ে মেঝেতে পড়ে থাকা রবোমানবের দলপতির দিকে এগিয়ে গেল। নিষ্ঠুর চেহারার দলপতি শূন্য দৃষ্টিতে দীর্ঘদেহী মানুষটির দিকে তাকিয়ে থেকে ফিস ফিস করে বলল, থুল সত্যি কথাই বলেছিল! আমাদের কেউ বেঁচে থাকবে না। আমরা সবাই সবাইকে মেরে ফেলব।
দীর্ঘদেহী রবোমানবটি লোহার রডটি ওপরে তুলে প্রচণ্ড বেগে নিচে নামিয়ে আনে। ঘরের দেওয়াল গোল ছোপ ছোপ রক্তে ভরে উঠতে থাকে।
২৭. টেবিলে কাচের জারে
টেবিলে কাচের জারে ডুবিয়ে রাখা মস্তিষ্কটিতে এক ধরনের বিবর্ণ রংয়ের ছোপ পড়েছে। লাল চুলের মেয়েটি সেদিকে তাকিয়ে থেকে বুঝতে পারল মস্তিষ্কটিতে এক ধরনের সংক্রমণ শুরু হয়েছে। গত কিছুদিন সে নিয়মিত তার বাসায় আসে নি, মস্তিষ্কটিতে প্রয়োজনীয় পুষ্টি দিতে পারে নি, ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ থেকে রক্ষা করতে পারে নি। তারা ভেবেছিল রবোমানবেরা সারা পৃথিবীকে দখল করতে যাচ্ছে—আসলে হয়েছে ঠিক তার উল্টো। বনের পশুর মতো এখন রবোমানবেরা পালিয়ে বেড়াচ্ছে।
বিজ্ঞান আকাদেমীর সভাপতি ঠিকই বলেছিল, ভয়ানক বিপদে রবোমানবেরা একে অন্যকে হত্যা করতে থাকে। এক ঘণ্টাও হয় নি তারা তাদের দলপতিকে হত্যা করেছে। নতুন দলপতি কে হবে সেটা নিয়ে বিরোধ হয়েছে, আরেকটু হলেই তাকেও হত্যা করে ফেলতো। অনেক কষ্ট করে সে বেঁচে এসেছে। সময় খুব কঠিন, নিজে বেঁচে আসার জন্যে তাকে অন্য সবাইকে খুন করে আসতে হয়েছে। সে নিজেও গুলি খেয়েছে, আঘাতটা কতোটুকু গুরুতর বুঝতে পারছে না, কোনো হাসপাতালেও যেতে পারছে না—নিজের বাসায় এসে আশ্রয় নিয়েছে।
লাল চুলের মেয়েটি ওঠে দাঁড়িয়ে যন্ত্রণার একটা শব্দ করে মস্তিষ্কের সুইচটি অন্য করে দিল। জিজ্ঞেস করল, তুমি জেগে আছ?।
মস্তিষ্কটি বলল, হ্যাঁ জেগে আছি। আমি আসলে জেগেই থাকি।
আমি কয়েকদিন আসতে পারি নি। তোমার পুষ্টি দিতে পারি নি।
আমি জানি। আমি বুঝতে পারছি আমার মাঝে এক ধরনের প্রদাহ শুরু হয়েছে। আমি খুব আশা করে আছি এখন আমি মারা যাব।
লাল চুলের মেয়েটি যন্ত্রণাকাতর শব্দ করে বলল, আমি তোমাকে মারা যেতে দেব না। আমি যতদিন বেঁচে থাকব ততদিন তোমাকে বাঁচিয়ে রাখব।
মস্তিষ্কটি বলল, তুমি এমন করে কেন কথা বলছ? তোমার কী কোনো যন্ত্রণা হচ্ছে?
হ্যাঁ।
কেন?
আমি গুলি খেয়েছি। আমার রক্তক্ষরণ হচ্ছে।
তোমাকে কে গুলি করেছে? মানুষ?
না। লাল চুলের মেয়েটি বলল, আমাকে অন্য রবোমানব গুলি করেছে। যেই রবোমানবকে আমি হত্যা করেছি তারা আমাকে গুলি করেছে।
মস্তিষ্কটি কিছুক্ষণ চুপ করে রইল, তারপর জিজ্ঞেস করল, তুমি কেন রবোমানব হয়ে রবোমানবকে হত্যা করতে গিয়েছ?
লাল চুলের মেয়েটি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, তুমি সেটা বুঝবে না।
তোমরা কি পৃথিবী দখল করে নিয়েছ?
লাল চুলের মেয়েটি প্রশ্নের উত্তর দিল না। মস্তিষ্কটি আবার জিজ্ঞেস করল, তোমরা কি পৃথিবী দখল করে নিয়েছ?
লাল চুলের মেয়েটি এবারেও প্রশ্নের উত্তর দিল না। মস্তিষ্কটা তখন একটু হাসির মতো শব্দ করল। বলল, তার মানে তোমরা পৃথিবী দখল করতে পার নি! আমি জানতাম তোমরা পারবে না।
লাল চুলের মেয়েটি এবারেও কোনো কথা বলল না। মস্তিষ্কটি নরম গলায় বলল, তোমার জন্যে আমার খুব মায়া হচ্ছে। তোমার সাথে প্রতিদিন আমি কথা বলেছি, আমি জানি তুমি অসম্ভব নিঃসঙ্গ একটি মেয়ে। রবোমানবের কোনো বন্ধু নেই। কোনো প্রিয়জন নেই। কোনো আপনজন নেই। আমি যেরকম অসম্ভব নিঃসঙ্গ—আমার যেরকম কোনো অস্তিত্ব নেই। আমার যেরকম শুরু নেই, শেষ নেই, আমি যেরকম অন্ধকার একটা জগতে থাকি, তুমি এবং তোমার মতো রবোমানবেরাও সেরকম অন্ধকার বোধহীন অনুভূতিহীন একটা জগতে থাক। তোমার জন্যে আমার মায়া হয়। মায়া হয় আর করুণা হয়। অসম্ভব করুণা হয়।