যেভাবে হঠাৎ গোলাগুলি শুরু হয়েছিল ঠিক সেভাবে গোলাগুলি বন্ধ হয়ে গেল। হলঘরের একপাশে গুলিবিদ্ধ তিনজন রবোমানব পড়েছিল। অন্য পাশে তরুণ-তরুণীরা। খুব ধীরে ধীরে তরুণ-তরুণীরা ওঠে দাঁড়াতে থাকে। শরীর থেকে ধূলা ঝাড়তে ঝাড়তে একজন বলল, রবোমানবদের বলা হয় নি আমরা অস্ত্রাগার ভেঙ্গে শুধু অস্ত্র নিই নি, গুলি নিরোধক পোশাকও নিয়েছি।
পঞ্চাশজন তরুণ-তরুণী তিনটি রবোমানবকে ঘিরে দাঁড়িয়ে রইল। একজন বলল, আমি কখনো চিন্তা করিনি আমি আমার হাতে অস্ত্র তুলে নেব, আমি সেই অস্ত্র দিয়ে কাউকে গুলি করব। আমি কখনোই কোনো প্রাণীর মৃত্যুর কারণ হতে চাই নি।
সোনালি চুলের মেয়েটি বলল, তুমি সেটি নিয়ে মাথা ঘামিও না। রবোমানব তিনটি গুলিবিদ্ধ হয়েছে, কিন্তু এখনো মারা যায় নি। হাসপাতালে নিলে বাঁচিয়ে ফেলবে।
একজন শুধু মুখ শক্ত করে বলল, আমরা এই প্রাণীগুলোকে বাঁচানোর চেষ্টা করব?
সোনালি চুলের মেয়েটি বলল, হ্যাঁ বাঁচানোর চেষ্টা করব।
কেন?
কারণ আমরা মানুষ। কারণ আমরা রবোমানব নই।
তিনজন গুলিবিদ্ধ রবোমানকে হাসপাতালে নিতে নিতে একজন তরুণ জিজ্ঞেস করল, সারা পৃথিবীতে এখন কী হচ্ছে কে জানে?
অন্য একজন বলল, ঠিক এখানে যা হচ্ছে নিশ্চয়ই সব জায়গাতেই তাই হচ্ছে।
তুমি তাই ভাবছ?
হ্যাঁ। নেটওয়ার্কটি ইচ্ছে করে বিকল করা হয়েছে।
তার মানে আমাদের নেটওয়ার্ক ছাড়া বেঁচে থাকতে হবে?
হ্যাঁ। আর মজার কথা কী জান?
কী?
আমরা নেটওয়ার্ক ছাড়াই কিন্তু বেঁচে থাকা শুরু করে দিয়েছি। সত্যি কথা বলতে কী, অভিজ্ঞতাটা কিন্তু খুব খারাপ না।
তরুণ কয়েকজন শব্দ করে হেসে উঠল। একজন তরুণী বলল, তুমি ঠিকই বলেছ! নেটওয়ার্কবিহীন জীবনটা আমার কাছেও মন্দ লাগছে না। এর মাঝে একটা স্বাধীন স্বাধীন ভাব আছে, কেমন যেন বনভোজনের আনন্দ আছে!
কয়েকজন মাথা নাড়ল, বলল, ঠিকই বলেছ!
২৫. বেশ কিছু মানুষের জটলা
বেশ কিছু মানুষের জটলার ভেতর থেকে উত্তেজিত কথাবার্তা শোনা যেতে থাকে। কাছাকাছি দাঁড়িয়ে থাকা একজন মহিলা আরেকজনকে জিজ্ঞেস করল কী হয়েছে এখানে?
রোমানবগুলো ধরা পড়েছে।
ধরা পড়েছে? মহিলার চোখ দুটো উত্তেজনায় চক চক করে ওঠে। কতো বড় বদমাইস দেখেছ? কী পরিমণ হিংস্র এই রবোমানবেরা–এদেরকে পিটিয়ে শেষ করে দেয়া দরকার।
কাছাকাছি দাঁড়িয়ে থাকা বুড়ো মানুষটি নরম গলায় বরল, আমরা তো মানুষ-আমরা তো কখনোই অন্য মানুষকে খুন করে ফেলার কথা বলতে পারি না।
কিন্তু রোমানবেরা তো মানুষ না?
তারা মানুষের একটা রূপান্তরিত রূপ। মস্তিষ্কে একটা পরিবর্তন এনে তাদেরকে দান করে ফেলা হয়।
মহিলাটি উত্তেজিত গলায় বলল, আমিও তো তাই বলছি। এই দানবগুলোকে শেষ করে দিতে হবে।
বুড়ো মানুষটি একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, দানবগুলোকে তো মানুষের সাথে তুলনা করলে হবে না। একটা বনের পশু যদি কারো ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তাহলে কী আমরা পশুটাকে দোষ দিই? পশুর তো দোষ নেই, তাদের তো সেই বুদ্ধিমত্তা নেই। এখানেও তাই–
তাহলে রবোমানবদের কী করব?
আপাতত আটকে রাখতে হবে, তারপর বিজ্ঞানীদের গবেষণা করতে দিতে হবে-তারা কোনোভাবে রবোমানবদের ভেতরে মানুষের প্রবৃত্তি ফিরিয়ে আনতে পারে কী-না।
পারবে না। কিছুতেই পারবে না।
বুড়ো মানুষটি হাসল, বলল, কিন্তু চেষ্টা করতে হবে তো?
ঠিক তখন জটলটা ভেঙ্গে গেল, দেখা গেল বেশ কিছু উত্তেজিত মানুষ কয়েকজন রবোমানবকে পিছমোড়া করে বেঁধে টেনে হিচড়ে নিয়ে যাচ্ছে। মহিলটি জিজ্ঞেস করল, কোথায় নিয়ে যাচ্ছ?
পুলিশ কমিশনারের কাছে।
কী করবে?
জেলখানায় আটকে রাখবে।
রাগী চেহারার একজন মানুষ বলল, এদেরকে খুন করে ফেলা উচিত। মনে আছে প্রথম কয়েকদিন আমাদের ওপর কী অত্যাচার করেছে? কতজনকে মেরেছে।
পিছমোড়া করে বেঁধে নেয়া মানুষগুলোর একজন বলল, আমাদের খুন করতে হবে না। একটা ঘরে বন্ধ করে রাখলে নিজেরাই নিজেদের খুন করে ফেলব। খবর পেয়েছি সব জায়গায় তাই হচ্ছে!
কী আশ্চর্য! কেন?
এদের ভেতরে কোনো ভালোবাসা নেই। আমাদের জন্যেও নেই, নিজেদের জন্যেও নেই।
মানুষগুলো রবোমানবদের টেনে হিঁচড়ে নিয়ে চলে গেল-পিছন পিছন অনেক মানুষ হৈ-হুল্লোড় করতে করতে যেতে থাকে। মহিলাটি সেদিকে তাকিয়ে একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, দুই সপ্তাহ আগেও যদি কেউ আমাকে বলত সারা পৃথিবীটা এভাবে ওলট-পালট হয়ে যাবে, আমি বিশ্বাস করতাম না।
বুড়ো মানুষটি বলল, তোমাদের এই শহরের কী অবস্থা?
প্রথম প্রথম খুব খারাপ অবস্থা ছিল। মানুষজন যখন বুঝেছে নেটওয়ার্ক ছাড়াই দিন কাটাতে হবে তখন আস্তে আস্তে সব ব্যবস্থা করতে শুরু করেছে।
বুড়ো মানুষটি মাথা নেড়ে বলল, ও আচ্ছা!
হ্যাঁ। প্রথম প্রথম সবাই অসম্ভব ক্ষেপেছিল, পরে বুঝতে পেরেছে। রবোমানবদের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার এ ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না। তখন সবাই মেনে নিয়েছে।
বুড়ো মানুষটি মাথা নাড়ল। মহিলাটি একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, এখন মোটামুটি সবকিছু নিয়ন্ত্রণের মাঝে আছে। আশে পাশের শহরের সাথে যোগাযোগ হয়েছে, দিন কেটে যাচ্ছে। তবে–
তবে কী?
শুধু একটা সমস্যা।
কী সমস্যা।
বাচ্চাদের স্কুলের সমস্যা। আগে নেটওয়ার্ক থেকে পাঠগুলো আসত—এখন সেরকম কিছু আসছে না। মানুষজনকে শিক্ষক হতে হচ্ছে। শিক্ষকের খুব অভাব। বিশেষ করে বিজ্ঞান আর গণিতের শিক্ষকের।