নুট মাথা নাড়ল, বলল, তুমি ঠিকই দেখেছ নীহা।
নীহা চমকে উঠে বলল, কী বলছ তুমি?
আমি ঠিকই বলেছি। নুট ফিসফিস করে বলল, আমি নিচে ছিলাম, স্পষ্ট দেখেছি একটা প্রাণীর মাথা সুহার মতো। আরেকটা ক্লদের।
কেমন করে সম্ভব?
এই প্রাণীগুলো মানুষের অঙ্গ প্রত্যঙ্গ ব্যবহার করতে পারে। সুহা আর ক্লদের শরীরকে এগুলো ভাগাভাগি করে নিয়েছে।
কী ভয়ংকর!
হ্যাঁ ভয়ংকর।
স্কাউটশিপটা গর্জন করে ওপরে উঠতে শুরু করতেই প্রাণীগুলো চিৎকার করতে করতে সরে গেল, নীহা প্রাণীগুলোকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দেখে। সেও এবারে স্পস্ট সুহা আর ক্লদকে দেখতে পায়। তাদের সত্যিকার চেহারার সাথে খুব বেশি মিল নেই, কিন্তু বুঝতে কোনো সমস্যা হয় না।
ইহিতা জানতে চাইল, নীহা! তোমাকে কি কিছু উৎকণ্ঠার মাঝ ফেলে দিল?
হ্যাঁ।
কী?
আমরা আগে এই গ্রহটা ছেড়ে চলে যাই, তখন তোমার সাথে কথা বলব। এখন বলতে চাই না।
ইহিতা মাথা নাড়ল, বলল, ঠিক আছে নীহা।
স্কাউটশিপটা তখন গর্জন করে লাল ধূলি উড়িয়ে আকাশে উঠতে থাকে। বহুঁ দূরে তখন মঙ্গলগ্রহের কুৎসিত চাঁদ ডিমোস আকাশে উঠতে শুরু করেছে।
মহাকাশযানের গোল জানালা দিয়ে মহাকাশযানে ঢোকার সাথে সাথে তারা ট্রিনিটির কণ্ঠস্বর শুনতে পায়, আমাদের মহাকাশযানে তোমাদের সাদর আমন্ত্রণ।
টর দাঁত কিড়মিড় করে বলল, খবরদার, বাজে কথা বলবে না ট্রিনিটি। তোমার মানুষকে আমন্ত্রণ জানানোর ক্ষমতা নেই, অধিকারও নেই।
ইহিতা শব্দ করে হাসল, বলল, টর! আমার মনে হয় ট্রিনিটির সাথে তোমার এই সংঘাতটুকু মিটিয়ে ফেল। বিষয়টা অর্থহীন। অনেকটা জুতো মোজা বা একটা স্ক্রু ড্রাইভারের সাথে ঝগড়া করার মতো। ট্রিনিটি একটা যন্ত্র ছাড়া আর কিছু না একটু গুছিয়ে মানুষের মতো কথা বলতে পারে—এই হচ্ছে পার্থক্য!
ট্রিনিটি বলল, ইহিতা, আমাকে তুমি যতোটুকু তাচ্ছিল্য সহকারে দেখছ আমি ঠিক ততোটুকু তাচ্ছিল্যের পাত্র নই। আমার হিসেব করার ক্ষমতা প্রায় মানুষের সমান। কয়েকটি বিশেষ বিষয়ে মানুষ থেকে বেশি।
ঐটুকুই। হিসাব করার ক্ষমতা! ইহিতা বলল, মানুষকে কখনো তার হিসাব করার ক্ষমতা দিয়ে বিচার করা হয় না।
ট্রিনিটি বলল, এই তর্ক সহজে শেষ হবে না। তোমরা নিশ্চয়ই ক্লান্ত। উষ্ণ পানিতে স্নান করে নতুন পোশাক পরে এসো, আমি তোমাদের খাবারের ব্যবস্থা করছি।
টর জিজ্ঞেস করল, খাবারের জন্য কী আছে?
তোমাদের নিরাপদ প্রত্যাবর্তনটুকু উদ্যাপন করার জন্যে আজকের মেনুতে থাকবে, বিশুদ্ধ প্রাকৃতিক যবের রুটি, তিতির পাখির মাংস, সামুদ্রিক মাছ এবং আঙুরের রস।
টর কিছুক্ষণ শূন্যের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, ট্রিনিটি, তুমি যদি সত্যি সত্যিকারের তিতির পাখির মাংস জোগাড় করতে পার তাহলে আমি তোমাকে ক্ষমা করে দেব।
ট্রিনিটি বলল, আমি সত্যিই তিতির পাখির মাংস জোগাড় করব।
পাশাপাশি পাঁচটি ক্যাপুসলের ওপর একটা সবুজ বাতি জ্বলছে এবং নিভছে। পাঁচজন নিজেদের ক্যাপসুলটি বের করে তার পাশে এসে দাঁড়াল। টুরান বলল, তাহলে আবার তোমাদের কাছ থেকে বিদায় নিই।
টর বলল, কততদিন পর আবার আমাদের দেখা হবে?
ইহিতা বলল, সেই প্রশ্নটির কোনো অর্থ নেই। আমাদের কাছে মনে হবে আমরা চোখ বন্ধ করেছি এবং চোখ খুলেছি। কাজেই তোমাদের সাথে দেখা হবে এক পলক পরে!
নীহা বলল, তাহলে আমাদের খুব আনুষ্ঠানিক বিদায় নেবারও প্রয়োজন নেই? আমরা ঝটপট ক্যাপসুলে শুয়ে পড়তে পারি?
ইহিতা মাথা নাড়ল, বলল, হ্যাঁ। ঝটপট শুয়ে পড়তে পারি।
টুরান বলল, শুধু পৃথিবীতে কী হচ্ছে সেই খবরটা জানতে পারলাম না।
ট্রিনিটি বলল, পৃথিবীর নেটওয়ার্ক বন্ধ হয়ে আছে। তার খবর পাবার কোনো উপায় নেই।
ইহিতা বলল, এক দিক দিয়ে সেটি হয়তো আমাদের জন্যে ভালো। পৃথিবীকে পিছনে ফেলে আমরা সামনে নতুন আরেকটা পৃথিবী খুঁজে বের করতে যাব।
নীহা বলল, ঠিক আছে তাহলে চল আমরা ক্যাপসুলে ঢুকি।
সবাই বলল, চল।
নুট বলল, এবারে আমি অনেক প্রশান্তি নিয়ে ঘুমুতে যাচ্ছি। তোমাদের সবার সাথে নতুন পৃথিবীতে দেখা হবে!
সবাই মাথা নাড়ল, তারপর ক্যাপসুলে ঢুকে গেল। ক্যাপসুলের ঢাকনাটা খুব ধীরে ধীরে নিচে নেমে আসে। ক্যাপসুলের ভেতর শীতল সুগন্ধি একটা বাতাস ছড়িয়ে পড়তে থাকে। বাতাসে নিশ্চয়ই কিছু একটা আছে, তারা কেউ চোখ খোলা রাখতে পারে না। একজন একজন করে তারা গভীর ঘুমে ঢলে পড়ল। তখন মৃদু কম্পন তুলে ক্রায়োজেনিক মডিউলটি চালু হয়ে যায়, সাথে সাথে পাঁচজন মহাকাশচারীর দেহ শীতল হতে থাকে। খুব ধীরে ধীরে জীবনের স্পন্দন থেমে যায়, পাঁচজন মানুষ পুরোপুরি পাঁচটি জড় পদার্থের মতো ক্যাপসুলের ভেতর শুয়ে থাকে।
মহাকাশযানটির ইঞ্জিনগুলো একটা একটা করে চালু হতে শুরু করে। কিছুক্ষণের মাঝেই পুরো মহাকাশযানটি থর থর করে কাঁপতে থাকে। সেটি খুব ধীরে ধীরে তার কক্ষপথ থেকে মুক্ত হয়ে মহাকাশের দিকে ছুটে যেতে থাকে। সৌরজগৎ পার হয়ে সেটি ছায়াপথের কেন্দ্রের দিকে ছুটে যেতে থাকবে। চারশ বিলিয়ন নক্ষত্রের কোথাও না কোথাও একটি চমৎকার গ্রহ খুঁজে পাওয়া যাবে যেখানে পৃথিবীর মানুষ নতুন করে তাদের সভ্যতা শুরু করতে পারবে।
২২. পুলিশ কমিশনার
পুলিশ কমিশনার অসহায়ভাবে হাত নেড়ে বললেন, আমি কী করব?
তাকে ঘিরে থাকা মানুষগুলো বলল, তাহলে কে করবে? তোমাকেই তো করতে হবে। তুমি আমাদের পুলিশ কমিশনার। তুমি না করলে কে করবে?